৩৬ বছর আগে দেখা সেন্টমার্টিন

সাইফুল ইসলাম রিপন

 

লেখাটি অনেকদিন আগ থেকেই লিখবো ভেবে আসছি। নানা কারণে হয়ে ওঠেনি। আমার বুয়েটের বন্ধু সাইদ বাবুর চাহিদা আর আমার আরেক বন্ধু নিশাত জাহান রানার স¤প্রতি সেন্টমার্টিন সফরের বর্ণনা পড়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে লিখতে শুরু করলাম। ভ্রমণ কাহিনি আমার ফেসবুক টাইম লাইনে এলেই পড়ি। বাংলাদেশের কোনো ভ্রমণ হলে একটু বাড়তি আগ্রহ নিয়ে পড়ি। আর সেটা যদি সেন্ট মার্টিনের হয় তো আর কথাই নেই। সেন্ট মার্টিনের লেখগুলো পড়ি আর মিলিয়ে নেয়ার চেষ্টা করি আমার দেখা সেন্ট মার্টিন! আমি ১৯৮৫ এর এপ্রিলে বাংলাদেশ মেসিন টুলস ফ্যাক্টরিতে চাকরি শুরু করি। একটু গুছিয়ে নিয়েই দল পাকাতে শুরু করি বেড়ানোর জন্য। খুব সহজ ছিল না বিষয়টা সে সময়। আমার সঙ্গে খুব সহজেই রাজি হয়ে যায় বুয়েটের বন্ধু মাকসুদ ফজল জ্যাকি। এখন ইংল্যান্ডে থাকে। আর ছিল জোবায়েদুল হোসেন মিঠু এবং সাইফুল আলম চঞ্চল। দুজনই রাজশাহী থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা। মিঠু স্বর্গবাসী হয়েছে। আর চঞ্চল বাংলাদেশে সিমেন্ট শিল্পে কর্মে নিয়োজিত। এর বাইরে ছিল মোজাম্মেল পাঠান। সে রাশিয়াতে লেখাপড়া করেছে। এখন টরেন্টো থাকে।

সবারই আগ্রহ ছিল কিন্তু একমতে পৌঁছাতে আরো কিছু অনুঘটক যোগ করতে হয়েছিল। প্রথমেই সিদ্ধান্তে আসতে হবে কোথায় যাব, চট্টগ্রাম। কেনো? যুক্তি হলো, আমাদের কাছে খবর ছিল পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে বিয়ার বিক্রি হয় ঢাকার অর্ধেক দামে। সুতরাং পতেঙ্গা গিয়ে বিয়ার পান করলেই আসা যাওয়ার খরচ উঠে যাবে! এটা ছিল একটা বড় অনুঘটক। যা হোক, আমরা পাঁচজন ট্রেনে করে চট্টগ্রাম যাই। একটা সস্তা হোটেলে উঠি। আমরা শুরুতেই ভাগ কওে নেই একেকদিন একেকজন সিঙ্গেল বেডে ঘুমাবে আর অন্যেরা দুজন এক বেডে ঘুমাবে। চট্টগ্রাম শহর আমার আগে তন্ন তন্ন কওে দেখা। খুব প্রিয় একটা শহর আমার। উঁচু নিচু পাহাড়ময়। মনটা একদম ভরিয়ে দেয়! ঢাকা থেকে যাওয়ার পথে সীতাকুন্ডু পৌঁছার আগেই শুরু হয় এই অনুভুতি! মাঝে মাঝে ডানদিকে সমুদ্র দেখা যায় আর বামে পাহাড়। ভাটিয়ারি, ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ, শিল্প এলাকাগুলি ছবির মত সুন্দর লাগে। সবুজ পাহাড়ের চূড়াগুলি কী অপরূপ! আমরা চট্টগ্রাম শহরটা ঘুওে বেড়াই। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বাটালি হিল, পাহাড়তলি, ওয়ার সিমেট্রি ঘুরে বিকালে যাই পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে।

সমুদ্রস্নান

পরদিন সকালে বাসে করে কক্সবাজার যাই। এটাও আমার পুরোনো জায়গা। এখানেও সস্তা একটা হোটেলে আমরা উঠি। দুপুরের খাওয়া সেরে সমুদ্রে যাই। তখন সমুদ্রের পাড়ে কী কী হোটেল ছিল আমার মনে নেই। পর্যটনের একটা মোটেল ছিল সবচেয়ে কাছে। খুব বেশি ভিড় ছিল না সে সময়। কক্সবাজারে সাইমন নামে একটা হোটেল ছিল। আমি যতবার গেছি, ঐ হোটেলে রাত্রে একটা ডিনার নিয়েছি। সেবারও তাই করি। ওরা বড় সাইজের রূপচান্দা মাছের ভাজি করতো। খেতে খুব মজা।

পরদিন সকাল থেকে শুরু হয় আমাদের সমুদ্রস্নান। সমুদ্রস্নান আমার ভীষণ প্রিয়। ওর ঢেউগুলির একটা তাল আছে। শরীরে ধাক্কা দিলে একটা বাজনা সৃষ্টি করে। একটা তালে সেই বাজনার সঙ্গে মিশে যেতে পারলে একটা নেশার সৃষ্টি হয়। অদ্ভুত এক নেশা! আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা উপভোগ করি সেই আনন্দ। আমার মেশিন টুলসের বন্ধুরা ভাবতো, রিপন হালকা-পাতলা বিড়িখোর, বোধহয় দম নাই। কিন্তু ঐদিন অবাকই হয়ে যায় আমার শারীরিক সামর্থ্য দেখে। বেশ লম্বা সময় সমুদ্রে কাটাই। হোটেলে ফিরে খাওয়া-দাওয়া বিশ্রাম সেরে আবার যাই সমুদ্রে। সুর্যাস্ত দেখতে।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বাসে চেপে টেকনাফ গেলাম। আমাদের সবার জন্য নতুন দিগন্তরেখা দেখা শুরু। তখন রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ ছিল। একদমই লক্কর ঝক্কর মার্কা। একদম পাহাড়ের গা ঘেঁষে উঁচু নিচু রাস্তা। এমন রাস্তা রাঙামাটিতেও আছে। কিন্তু টেকনাফের এই রাস্তাটির ডানপাশে পাহাড় আর বাম পাশে নীল নাফ নদী। অপরূপা! একদম চুলের নীল ফিতার মতো পরে আছে। এই সুন্দরের বোধ হয় তুলনা হয় না। বাংলা ব্যাকরণ অনুসারে নাফ নদ হবার কথা, কিন্তু সবাই নদী বলে। জানিনা এর কারণ কি। নদীর পানি সাধারণত নীল হয় না, কিন্তু নাফ তার ব্যতিক্রম! আর এই সৌন্দর্য্যরে মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয় নাফ নদীর ওপারে বার্মার পাহাড়গুলি। আমার পৃথিবী ঘুরে দেখা দেশের সংখ্যা অনেক, তবুও এই লেখাটা লিখতে বসে, বিশেষ করে এই জায়গাটুকুর তুলনা আমি খুঁজে পেলাম না। পাখির চোখে দেখা নাফ নদী। আমি জানি না এখনও তেমন আছে কি না!

আসলে নাফ কোনো নদী নয়। নদী হচ্ছে একটি জলধারা, যেটা কোথাও থেকে উৎপত্তি হয়ে সাগরে কিংবা হ্রদে যেয়ে মেশে। কিন্তু নাফ নদীটা তা নয়। এটা সমুদ্রের একটা বর্ধিত অংশ। যেটা স্থলের ভিতর ঢুকে পড়েছে। টেকনাফ বাসস্ট্যান্ডে নেমে হোটেলের খোঁজ করি। বেশ কয়েকজন নতুন একটা পাকা হোটেলের সন্ধান দিলো। তখন টেকনাফে পাকা হোটেল খুব একটা ছিল না। খুঁজে বের করলাম সেটা। নাফ নদী থেকে একটা খালের মতো আছে যেটা বেঁকে ঢুকেছে টেকনাফ বাজারের দিকে। খালের উপরে একটা ব্রিজ। সেটা পার হয়ে পশ্চিম দিকে গেলেই হাতের ডান দিকে ছিলো হোটেলটা। তখন একদমই নতুন। হোটেলে আমরা স্নানাহার শেষ করি। এই যে খালটার কথা বললাম, সেটা দিয়েই টেকনাফের সঙ্গে নৌ পথে যোগাযোগ। খালে শুধু জোয়ারের সময় পানি আসে। আর ভাটাতে প্রায় শূন্য! দিনে দুই বার জোয়ার। আর এই জোয়ারের সময়ই নৌযান গুলির চলাচল। এই খালটা থেকে নৌযানগুলি বিভিন্ন জায়গায় ছেড়ে যায়।

আমরা দেখতে বের হলাম। এ সময় ছিলো ভাটা। একদম অল্প পানি। কিছু নৌযান বাঁধা। সেন্টমার্টিন যেতে হলে এখান থেকে নৌকাতে করে যেতে হবে। দেশি কাঠের তৈরি নৌকা। যাত্রী এবং মালামাল সবই পারাপার করে এরা। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় খালটার মুখের কাছে চলে যাই। ডান দিকে নাফ নদীর নীল জল। আমার এক খেয়াল চাপলো ঐ জল ছুঁয়ে দেখবার। ভাটার সময় জলটা বেশ দূরে। আর এই দূরত্বটা শুধু কাদায় ভরা। বিশ্রী রকমের কাদা। আমার সাথীরা কেউ রাজি হয় না। আমি জিন্সের প্যান্টটা হাঁটু অবধি ভাঁজ করে হাঁটা দেয়। ঠিকই ছুয়ে আসি সেই নীল জল। এখন মনে হয়, কাজটা ঠিক করি নাই! যাই হোক, ওখান থেকে হেঁটে হেঁটে বার্মিজ মার্কেটে যাই। খুব একটা মনে নাই বিশেষত্বটা কী! মুলত বার্মিজ স্যান্ডেল আর মেয়েদের সাজগোজের কিছু জিনিস থাকবে। রাতের খাওয়া সেরে হোটেলে ফিরি।

পরদিন সকালে উঠে আমাদের পরিকল্পনা হলো টেকনাফ দর্শন। মাথিনের কূপটা তো দেখতে হবেই। কারণ, সেটার সাথে ‘যখন পুলিশ ছিলাম’ এর স্রষ্টা ধীরাজ ভট্টাচার্য্যের স্মৃতি জড়িত। সারাদিন টেকনাফের নানা স্থান দর্শন শেষে বিকালে সেন্ট মার্টিন যাওয়ার নৌকা ওয়ালাদের সঙ্গে কথা বলে আমাদের যাওয়া কনফার্ম করি। যেহেতু আমরা দুই রাত সেন্ট মার্টিন থাকব, তাই থাকা খাওয়ার কি ব্যবস্থা আছে জানার চেষ্টা করি। এইসব শেষ করে ঘুমের আয়োজন। ঘুমিয়ে পরলাম পরদিন সেন্ট মার্টিন যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে দেখতে। আমাদের স্বপ্নের সেন্ট মার্টিন যাত্রা শুরু হলো। নির্দিষ্ট সময়ে আমরা ঘাটে আসি। বেশ কিছু যাত্রী আর মালামালের ভিতরে আমাদের ঠাঁই হলো। উঠে পরলাম নৌকাতে। সেই প্রথম আমাদের সমুদ্র যাত্রা। অসম্ভব উত্তেজনা! এই জোয়ারের সময় সব নৌকাগুলি ছাড়ে টেকনাফ থেকে যাওয়ার জন্য। আবার ঠিক তেমনই যাদের টেকনাফে আসার, তারাও ফিরে আসে এই সময়টাতেই। এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

আমাদের নৌকা ছেড়ে দিলো। খালের ভিতরে একটু এগোতেই পাশে আরেকটা নৌকা, যেটা সেন্ট মার্টিন থেকে ফিরছে, সেখান থেকে রিপন ভাই বলে একটা চিৎকার। আমি অবাক হয়ে গেলাম, এত দূরে এসেও আমার পরিচিত কেউ! তাকিয়ে দেখি তালিম। ও বুয়েটে আমার জুনিয়ার। ওরা সেন্ট মার্টিন থেকে ফিরছে। খালটা ছাড়িয়ে আমরা নাফ নদীতে পড়ি। সেখান থেকে দক্ষিণে যাত্রা। বঙ্গোপসাগরের দিকে। ডান দিকে বাংলাদেশ আর বাম দিকে বার্মা। এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য! আস্তে আস্তে আমরা বাংলাদেশের স্থল সীমা পেরিয়ে বঙ্গপোসাগরে পড়ি। অসম্ভব এক শিহরণ! গাংচিলগুলি ঘিরে ফেলে নৌকাটাকে। আসলে নৌকার প্রপেলারে ধাক্কা খেয়ে যে মাছগুলি মরে, সেগুলি খাওয়া এদের উদ্দেশ্য। কারণ যেটাই হোক, দৃশ্যটা তুলনা হয় না। বাংলাদেশের স্থল ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসে। সেই প্রথম আমার দূর থেকে দেখা বাংলাদেশ! আমরা গভীর সমুদ্রে এসে পরি। বড় বড় ঢেউ শুরু হয়। নৌকাটা যেন আঁছড়ে পড়ে! তখন লাইফ জ্যাকেটের কোনো বালাই ছিল না। আমার মৃত্যুভয় সব সময় কম কিন্তু আমাদের ভিতরে চঞ্চল খুব ভয় পেয়ে যায়। এভাবে ভয় আর ঢেউয়ের শিহরণ গায়ে মাখতে মাখতে এসে পড়ি সেন্টমার্টিনের তটে। দূর থেকে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করে সেন্ট মার্টিন! বাড়তে থাকে উত্তেজনা। তখন সেন্টমার্টিনে কোনো ঘাট ছিল না, সমুদ্রতটেই নৌকা ভীড়তো।

ওই যে দেখা যায় সেন্টমার্টিন

ঘাটে নৌকা ভিড়তেই আমরা লাফিয়ে নামলাম। সেই প্রথম প্রবাল দ্বীপে আমাদের পা পড়লো। । এই জমে যাওয়া মরা প্রবালগুলে খুব ধারালো! একদম ছুরির মতো। একটু বেকায়দায় পরলেই পা কেটে যাবে। তাই নৌকা থেকে নেমে অল্প পানির ভিতর দিয়ে হেঁটে আমরা বালির উপর আসি। শুরু হয় আমাদের সেন্ট মার্টিন আবিস্কার করা আর অবাক হবার পালা! আমরা জেনে এসেছি যে নৌকা থেকে নামলেই একটা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। নেমে দেখি দুই তিনটা টং ঘর। সেখানে সিগারেট, চকলেট ধরনের কিছু বিক্রি করে। তাহলে খাবো কোথায়! আর থাকা!! একজন বললো অপেক্ষা করেন, রান্নার লোক আসবে। ঠিক আছে। আমার সেন্ট মার্টিন দেখার তর সইছে না! ভাবলেম একটু হেঁটে আসি, কিন্তু ব্যাগ রাখবো কোথায়? জানতে চাইলে স্থানীয়রা বললো, কেনো! বালুর উপর রেখে যান, কেউ হাত দিবে না। অবাক হলাম! সত্যিই সে সময়ে সেন্ট মার্টিনে চোর/চুরি বলে কিছু ছিলো না।মনে হলো পদ্মা নদীর মাঝির ময়না দ্বীপে এসে গেছি। আরও অবাক হলেম কোনো ভিক্ষুক নেই। যেখানে ঢাকা শহরে ভিক্ষুকের যন্ত্রনায় আমরা দূর্বিষহ অবস্থা! আর একটা জিনিস আমার চোখে পরলো, সেটা হলো কুকুর। কোনো নেড়ি কুত্তা না। খুব সুন্দর, মাঝারি সাইজের একদম অন্য একটা জাতের কুকুরগুলি। লোমস শরীর আর মোটা ফুলানো লেজ।


কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘোরা ফেরা করতেই একজন এসে বললো, সেই রেস্টুরেন্টের মালিক। যা আমরা খেতে চাই, তাই রান্না করে দেবে। আমরা বললাম দুপুরে মুরগীর মাংস আর রাতে মাছ। ব্যাস খাওয়ার সমস্যা মিটে গেলো। কিন্তু রাতে থাকা! তখন একটাও হোটেল ছিল না সেন্ট মার্টিনে। সব টিন অথবা বাঁশের বাড়ি। একমাত্র পাকা বিল্ডিং বলতে ইউনিয়ন পরিষদ এবং সরকারি কাজে ব্যবহৃত ডাক বাংলো। আমরা থাকবো কোথায়? অগত্যা রেষ্টুরেন্টের মালিকই ভরসা। তার টং এর সাথেই বাঁশের মাচা করা আছে। নাম মাত্র বালিশ,চাদর এই সব আছে। তবে এর জন্য কোনো বাড়তি পয়সা লাগবে না। কি চমৎকার আতিথেয়তা! খুব ভালো লাগলো। আমরা ব্যাগগুলি ঐ মাচার উপর রেখে দ্বীপ দর্শনে বের হয়ে গেলাম।

তখনকার টং ঘর 

আমার ইচ্ছা সম্পূর্ণ দ্বীপটা একদম সমুদ্রের পাড় দিয়ে চক্রাকারে হাঁটবো। সেটা আট নয় কিলোমিটারের বেশি হবে বলে আমার মনে হয় না। ছোটবেলায় কেয়া ফুল দেখেছি। বাবা বর্ষাকালে কেয়া ফুল এনে বাসায় রাখতেন। তীব্র একটা গন্ধ। কেয়া গাছও দেখেছি। কিন্তু সেন্ট মার্টিনে সারি সারি কেয়ার বন, পিছনে সমুদ্র, কি যে সুন্দর! আমার সাথীরা কেউ অত হাঁটতে চাইলো না। অগত্যা আমিও ওদের সঙ্গে গ্রামটার ভিতর দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। গ্রামের প্রায় সব মানুষই মাছ ধরার কাজ করে। গভীর সমুদ্রে যায় এরা মাছ ধরতে। কয়েকদিন পরে ফেরে। সবার অবস্থাই স্বচ্ছল মনে হলো। বাড়ির আঙিনাগুলি হয় বাঁশ অথবা নারিকেল পাতা দিয়ে ঘেরা। ও হ্যা, নারিকেল গাছ সর্বত্র। সবখানেই খুব পরিস্কার। কোথাও ময়লা ফেলবার চিহ্ন নেই। মানুষের সাথে কথা বলে খুব শান্তি লাগে আমাদের। ভীষণ আন্তরিক এবং ভালোমানুষ এরা। অনেকটা সময় ঘুরে আমরা ফিরে আসি আমাদের সেই টং রেষ্টুরেন্টে। মুরগীর মাংস আর ভাত। কী ঝালরে বাবা! একদম মাথা গরম করে দেওয়ার মতো ঝাল। তবুও পেট ভরে খেলাম।

খাওয়ার পর চঞ্চল বিগড়ে গেল! প্রথমত সে খুবই ঘর কাতুরে। বাবা-মাকে ছাড়া কয়েকদিন থাকলেই ওর সমস্যা হয়। দ্বিতীয়ত নৌকাতে সে ভীষণ ভয় পেয়েছিল। ভেবেছিল যে আর ওর বাবা-মার সাথে দেখা হবে না। আর শেষে এই ঝাল মুরগি! সব মিলিয়ে তার চিৎকার শুরু হলো যে সে ফিরে যাবে। পরের জোয়ারেই। দুই রাত কেন, এক রাতও থাকবে না! আমার সাথে লেগে গেলো ঝগড়া। সে এক ভীষণ অবস্থা। অত সুন্দর একটা নির্জন দ্বীপে উচ্চকন্ঠে আমি আর চঞ্চল! যাই হোক, শেষে ঠিক হলো আমরা একরাত থেকে সকালের জোয়ারে ফিরব। আর চঞ্চলকে বলে দিলাম, ওর সঙ্গে জীবনেও বেড়াতে বের হবো না।

১৯৮৫ সালের সেন্টমার্টিন

দুপুরের খাওয়া শেষ করে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার বের হওয়ার ইচ্ছা। এবার যাবো দ্বীপের পশ্চিম দিকটাতে। সুর্যাস্ত দেখে ফিরবো। ওরা কেউ আর হাঁটতে রাজি না। আমার একেতে চঞ্চলের উপর রাগ। মন ভালো নেই। আর একা থাকতে চাইছিলাম। একাই হাঁটা দিলাম দ্বীপের পশ্চিম দিকে। পুরোটা সন্ধ্যা কেয়ার ঝোপের পাশে বসে সুর্যাস্ত উপভোগ করলাম। সন্ধ্যার পরে আবার সেই মাচায় ফিরলাম। রাতের মাছ রান্নাতে ঝাল একটু কম ছিল। খেয়েদেয়ে আমরা মাচার উপর শোবার আয়োজন করছি। এর মধ্যে এক স্থানীয় ভদ্রলোক এসে আমাদের সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিলেন। আলাপ করতে করতে এমন অবস্থা হলো যে তিনি আমাদের এই মাচাতে শুতে দেবেন না। ওনার বাড়িতে যেয়ে ঘুমাতে হবে। হবে মানে হবেই। একদম নাছোড়বান্দা। অগত্যা রাজি হতে হলো। বাড়িটার উপরে টিনের চাল মেঝেটা পাকা। সেখানেই আমাদের বিছানা। পরেরদিন সকালে উনি আমাদের প্রাতরাশ করিয়ে গাছ থেকে ডাব পারিয়ে সেই পানি খাইয়ে বিদায় করলেন। এমন আতিথেয়তা! ভাবাই যায় না!


আমরা ফিরে আসি ভীষণ অপূর্ণতা নিয়ে। মনে হয় একটা পূর্ণিমা রাত যদি ঐ বালুতটে মুক্ত আকাশের নিচে ঘুমাতে পারতাম! কিংবা একটা সপ্তাহ যদি জেলে হয়ে ঐ সমুদ্রে মাছ ধরতে পারতাম! ফেরাটা খুব সহজ। ভোরের জোয়ারে টেকনাফ। সরাসরি বাসে চট্টগ্রাম। এরপর ট্রেনে ঢাকা।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন