১৯ হাজার টাকায় ১৯ দিনের ভারত ভ্রমণ (পর্ব-৬)

ফাহিম কবীর

ট্রেক টু গুলমার্গ

 

শ্রীনগর টু গুলমার্গঃ

পরদিন ঘুম থেকে উঠলাম সকাল আটটার দিকে । উঠে ফ্রেশ হয়ে রেডি হতে হতে সাড়ে নয়টা বেজে গেলো । রুমের ভাড়া বেশ যৌক্তিক মনে হওয়ায় চারজন রুম বুক রেখেই হোটেল থেকে বেরিয়ে গেলাম। শ্রীনগর থেকে গুলমার্গ ৫৩ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত । যেতে সময় লাগে দেড় ঘণ্টা । ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ডে গাড়ির নির্ধারিত ভাড়া হলো ২৪৮৬ রুপী । আমি গতদিনের সাথে মিলিয়ে ঐকিক নিয়মে হিসেব করলাম, ৮৩ কিলোমিটারের জন্য যদি ভাড়া দেই ২০০০ রুপী (ফিক্সড ৩৪০৫), তাহলে ৫৩ কিলোমিটারের জন্য ভাড়া আসে প্রায় ১৫০০ রুপী(ফিক্সড ২৪৮৬) । আমি এই হিসেবে গাড়ি ঠিক করার কথা ভাবছিলাম । দুই একটা গাড়ির সাথে কথা বলে ইতিবাচক সাড়াও পেয়েছি । এরমধ্যেই দেখি সূর্য ভাই ১৮০০ রুপীতে গাড়ি ঠিক করে নিয়ে এসেছে । মনক্ষুন্ন হলেও গাড়িতে চেপে বসলাম । সকাল দশটার দিকে যাত্রা শুরু করলাম । প্রসঙ্গত, বলে রাখা ভালো যে শ্রীনগর হলো কাশ্মীরের কেন্দ্র। আর বিভিন্ন ট্যুর স্পটগুলো সব শ্রীনগর থেকেই ভিন্ন ভিন্ন ডিরেকশনে চলে গেছে । এরমানে হলো আপনি যেখানেই যান না কেনো, শ্রীনগরের উপরে দিয়েই যেতে হবে । শ্রীনগর থেকে পেহেলগাম ৯০ গুলমার্গ ৫৩ সোনমার্গ ৮৩ দুধপত্রী ৪৫ এবং নিশাতবাগ ১১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। গুগল ম্যাপে ডিরেকশন টা দেখে নিতে পারেন।

ভেড়ার পালের রাস্তা পারাপার

আমাদের গাড়ি চলা শুরু করলো । ড্রাইভার কে আগেই বলে দিয়েছিলাম যে একটা ভালো হোটেলের সামনে দাঁড়াতে, ব্রেকফাস্ট করবো । সেই হিসেবে উনি আমাদের একটা হোটেলের সামনে নামিয়ে দিলেন । খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ফের গাড়ি চলা শুরু করলো । বিশাল বিশাল মন মাতানো পাইন বাগানের বুক চিরে বয়ে চলা মসৃণ রাস্তা ধরে ছুটে চলছিলো আমাদের গাড়ি । কাশ্মীরে পথ চলার একটি জিনিস আমার খুব মজা লাগে । সেটা হলো - চলতে চলতে হঠাত দেখা যায় বিশাল এক পাল ভেড়া রাস্তা পার হচ্ছে । গাড়িগুলোও কোন হর্ণ না দিয়ে ভেড়াদের রাস্তা পার হওয়া অবধি অপেক্ষা করে । বেলা বারোটা নাগাদ আমরা গুলমার্গ ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ডে গিয়ে পৌঁছাই । এখানে থেকে আবার সেই পনির রাইড নিয়ে যেতে হয় গুলমার্গ ফার্স্ট ফেজে । অনেক টাকা চায় । ৭০০-১৫০০ যার কাছে যেমন পায় । আমাদের পনিরে নেয়ার জন্য কয়েকজন কতভাবেই যে অনুনয় বিনয় করলো, বলার নাই কিছু । প্রায় আধাঘন্টা তারা আমাদের পিছু পিছু এসেছে । শেষ পর্যন্ত তারা আমাদের কাছে সুবিধা করতে পারেনি।

 

গণ্ডোলা রাইড সমাচারঃ

গণ্ডোলা রাইড হলো ক্যাবল কারে চড়া । আমি গণ্ডোলা নামটা আগে কখনো শুনিনি, জানিনা এটি কাশ্মীরের নিজেদের দেয়া নাম নাকি পৃথিবীতে আরো কোথাও এই ক্যাবল কার ব্যবস্থাকে গণ্ডোলা বলে থাকে ! গুলমার্গের এই গণ্ডোলা রাইডটি পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ উচ্চতায় অবস্থিত ক্যাবল কার ব্যবস্থা । ফেজের ব্যাপার টা একটু ক্লিয়ার করি । গুলমার্গ ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ড থেকে বরফের পাহাড়ের শুরুর অংশটা হলো ফার্স্ট ফেজ, জায়গাটার নাম কুংডোর। ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে হেঁটে, পনিরে বা গণ্ডোলায় চড়ে ফার্স্ট ফেজে যাওয়া যায় ।

গণ্ডোলা রাইড সমাচার

আর সেকেণ্ড ফেজ হলো বরফের পাহাড়ের একেবারে উপরের অংশটা, জায়গাটার নাম আপারওয়াথ । ওখানে হেঁটে যাওয়াটা নরমালি পসিবল না, পনিরও যায় না । সেকেণ্ড ফেজে যাওয়ার একমাত্র উপায় হলো গণ্ডোলা রাইড ।  গণ্ডোলা রাইডের ব্যাপারটা বাইরে থেকে দেখতে ব্যাপক লেগেছে আমার কাছে । যদি টাকাপয়সার সমস্যা না থাকতো, তাহলে হয়তো এক্সপেরিয়েন্স নিতাম । শখ থাকলেও সাধ্যের খাতিরে বাদ দিতে হয়েছে।  গুলমার্গ টু কুংডোরের গণ্ডোলা ফি ৭৪০রুপী। সময় ৯মিনিট। আর কুংডোর থেকে আপারথের ফি ৯৫০ রুপী। সময় ১২মিনিট । এই ফি টা আপ-ডাউন মিলিয়ে ধরা হয়েছে । রেট বেশ হাই মনে হয়েছে আমার কাছে ।

 

 ট্রেক টু গুলমার্গঃ

যাহোক, আমরা হেঁটে হেঁটে পথ চলা শুরু করলাম । এখানেও সেই আগের কথাই । কোথাও কোন আর্টিকেলে পাইনি যেখানে বলা আছে কুংডোর হেঁটে যাওয়া যায় । সবাই ক্যাবল কার আর শিকারার কথা বলেছে । আমরা ওখানে এসব কিছুই নেইনি । পুরোটা হেঁটেই গিয়েছি। তবে হ্যাঁ এজন্য বেশ পরিশ্রম করতে হবে। অনেক লম্বা রাস্তা, আর বেশ খাড়া। সোনমার্গের রাস্তার মতো এতো সহজ ছিলো না গুলমার্গের রাস্তা । এজন্যই আমি এই পয়েন্টের নাম দিয়েছি - ট্রেক টু গুলমার্গ । ভালোই কষ্ট হয়েছে এই পথে হাঁটতে গিয়ে । অনেক সময় লেগেছে কুংডোর পৌঁছাতে । আমরা প্রায় ১২ টায় রওনা দিয়ে তিন ঘন্টা ট্রেকিং করার পরে তিনটার দিকে পৌঁছাই কুংডোর। অবশ্য এই সময়টা যে পুরোটা শুধু হেঁটেছি, তা নয়। খেয়েছি, বিশ্রাম নিয়েছি, আড্ডা দিয়েছি । আমাদের এতো কিসের তাড়া দ্রুত পৌঁছানোর! তবে এই যে কষ্টগুলো হয়েছে, কেনো যেনো এগুলো একটুও গায়ে লাগেনি। ট্রেকিং এ গেলে শরীর ক্লান্ত হয়, বাট মন উৎফুল্ল হয় । শরীরের ক্লান্তির সাথে মনের ক্লান্তি যুক্ত হলে তাকে বলে স্ট্রেস । আমি ক্লান্ত হয়েছি, স্ট্রেসড হইনি কখনো । স্ট্রেসড হবো কিভাবে বলেন, এ যেনো সৌন্দর্যের সমুদ্র । আহা! নয়ন, মন ভরে যায় একদম । মানুষ স্ট্রেসড হয় বিরক্তি থেকে, মুগ্ধতা থেকে নয় । প্রেমিকার হাত ধরে দিনভর কড়া রোদে হেঁটে যেতে কেউ স্ট্রেসড হয়না, স্ট্রেসড হয় সেই মানুষটাই যখন একলা ঘরে ফেরে ।

ফার্স্ট ফেস

দৃষ্টিসীমার চারিদিকে সুউচ্চ পাইন গাছের বন, সবুজ মাঠ আর ফুলের গাছ । এসবের মাঝেই ছিলো আমাদের পথ । মুগ্ধতায় কেটেছে সারাটাদিন । যে মানুষ মুগ্ধ হুতে পারেনা, সে কখনো ভালোবাসতে পারেনা । তাছাড়া আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রচুর হাঁটতে পছন্দ করি । একলা মানুষ কানে ইয়ারফোন দিয়ে অনর্থক অনেক রাস্তা হেঁটেছি। আমার একটা বিশেষ ইচ্ছে, যে মেয়েটাকে বিয়ে করবো, তারও যেনো হাঁটতে ভালো লাগে । তাকে নিয়ে আমি এরকম কম খরচের ট্যুর দেবো । কিন্তু কম ট্যুর দেবো না - এটা নিশ্চিত ।

 তিনটার দিকে কুংডোর পৌঁছাই । বিশাল বরফের পাহাড় । চারিদিকে শুভ্র বরফ । মাথার উপরে রোদ, পায়ের নীচে বরফ আর হিমহিম শীত । বেশ মজার ব্যাপার । অনেক্ষণ ওদিকে হাঁটাহাঁটি করলাম। ভালোই লাগলো । এখানেও দেখলাম বরফে খেলাধুলা করার নানা সরঞ্জাম রাখা হয়েছে । বেশ দাম সেগুলোর।হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম ক্যাবল কারের কাছে । ওখানে গিয়ে ক্যাবল কারের ফাংশন দেখছিলাম । এটা জম্মু-কাশ্মীর সরকার আর ফ্রান্সের একটা কোম্পানীর মিলিত প্রজেক্ট।বেশ সুন্দর ব্যবস্থাপনা ওখানে ।ঘণ্টা দুয়েক পরে বেলা পাঁচটার আবার ফিরতি পথে শুরু করি । এবারে দেখার চেয়ে ফেরার তাড়াটাই বেশি ছিলো । তাই কখন গাড়ির কাছে যাবো, সেই ব্যাপার টাই বেশি মাথায় কাজ করছিলো । শুরুতে খাড়া পাহাড় বেয়ে শুধু উঠেছি, তাও খারাপ লাগেনি । এবার নামার পালা, তাও মনে হচ্ছিলো গন্তব্য আর কতদূরে । একাধারে শুধু নীচের দিকে নেমেই গেছি, নেমেই গেছি । প্রায় দেড়ঘন্টা টানা হেঁটে সাড়ে ছয়টা নাগাদ গাড়ির কাছে পৌঁছাই ।

গুলমার্গ মানেই সবুজের ভেতর দিয়ে হেটে চলা

গাড়িতে চড়া মাত্রই একটানে শ্রীনগর এনে নামিয়ে দেয় । আটটার দিকে হোটেলের রুমে ফিরে ফ্রেশ হয়ে রাতের খানা খেতে বের হই । এরপরে পরবর্তী দিনের প্ল্যান । এই দুইটা দিন মহারাষ্ট্রের দুই ভাই এর সাথে বেশ ভালোই কেটেছে । তারা দুইজনেই জব করে । তাদের ছুটি শেষ । ফিরে যাবে নিজ গন্তব্যে । আগামীকাল বিকেলে তাদের ফ্লাইট । কিছুটা মুড অফ হয়ে গেলো এজন্য । ভালোই তো ঘুরছিলাম একসাথে, এখন দুইজন মিলে ঘোরাটাও সমস্যা হবে । আগামীকাল তবে কি করা যায় - আমি আর সুফল মিলেও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাম । সেই সিদ্ধান্তহীনতা থেকেই জন্ম নিলো - নষ্ট একটি দিনের গল্প ।

 

দুইজনের আজকের খরচঃ (০২/০৬/১৯)

 

১। ব্রেকফাস্ট = ১১৫/-

 

২।  গুলমার্গে দুপুরের খাবার = ১৩০/-

 

২। গাড়ি ভাড়া (২জন) = ৯০০/-

 

৩। খাওয়া = ১৬০/-

 

৪। হোটেল ভাড়া = ৪০০/-

 

মোটঃ ১৭০৫ রুপী

 

এক্স্যাক্ট রুটঃ

 

ঢাকা>কলকাতা>দিল্লি>জম্মু>শ্রীনগর>কার্গিল>লেহ>প্যাংগং>লেহ>মানালি>দিল্লি>কলকাতা>ঢাকা

 

 (চলবে....)

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন