শোয়ায়েব চমক
থাইল্যান্ডে গিয়ে নোরালি জানতে পারে যদি কেউ নিজের বাহন নিয়ে ঘুরতে চায় তাহলে একজন গাইড সঙ্গে থাকতে হবে। কিন্তু নোরালির তো কোন গাইড নেই। মিয়ানমারে যে গ্রুপের সঙ্গে নোরালি ঘুরছিল তাদের প্রায় সবাই থাইল্যান্ড যাচ্ছে তাই গ্রুপের সমস্যা নেই। এখন গাইড যোগাড় করতে হবে। যাই হোক তারা সবাই মিলে চলে আসল মিয়ানমার-থাই বর্ডারে। সেখানে ইমিগ্রেশন আর কাস্টমস এর বিভিন্ন অফিসে ঘোরাঘুরি করে নোরালি আর তার দল গাইড ছাড়াই স্বাধীনভাবে যে যার মত থাইল্যান্ডের ভেতর বাইক চালাবার এর অনুমতি পেল। নোরালিকে দেয়া হল ৩০ দিনের ভিসা। সমস্যা দেখা দিল বাসন্তীর কাগজপত্রে। কারণ, অফিসিয়ালি বাসন্তীর মালিক নোরালি না। যারা আগের পর্বগুলো পড়েছেন তাদের নিশ্চয়ই মনে আছে নোরালি ভারত থেকে এই মোটরসাইকেলটি কিনেছে। বিদেশি হবার কারণে সে নিজের নামে এটাকে রেজিস্ট্রেশন করতে পারেনি।যাই হোক থাই কাস্টমস অফিসে নোরালি পুরো ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করে তার সঙ্গে থাকা বাইক চালানোর সরকারি কাগজপত্র দেখালো। থাই কতৃপক্ষ বাসন্তীর কাগজপত্র বেশ অনেক সময় ধরে পরীক্ষা করে স্ট্যাম্প মেরে দিল। বাসন্তীকে নিয়ে থাই ভ্রমণে আর কোন বাঁধা থাকল না।
নোরালি কোথাও না থেমে সোজা চলে এল থাইল্যান্ডের ছিয়াংরাই শহরে রাত কাটাতে। ছিয়াংরাই একরাত কাটিয়ে নোরালি রওনা দিল ছিয়াংমাই শহরের দিকে। পথে এক জায়গায় থেমে সকালের নাস্তা করে আবার চলতে লাগল সে। এক জায়গায় নোরালি দেখে রাস্তার পাশে বেশ ধোঁয়া উঠছে আর বেশ কিছু মানুষের জটলা। কৌতুহলী হয়ে নোরালি থামল। গিয়ে দেখে সেটা আসলে থাইল্যান্ডের বিখ্যাত “ Wiang Pa Pao Hot Spring Stop" সেখানে একটা মজার জিনিস নোরালি দেখতে পেল। এলাকার মানুষেরা বসে বসে সেখানে ডিম সিদ্ধ করছে!! বড়ই আজব!!
সন্ধ্যার পর নোরালি ছিয়াংমাই চলে আসে। এখানে তার বেশ কয়েকদিন থাকার পরিকল্পনা আছে। বিশ্রাম, মোটরবাইকের কিছু কাজ করানো, ইউটিউবের জন্য ভিডিও তৈরি, হালকা কিছু শপিং ইত্যাদি। দিন তিনেক বিশ্রাম শেষে নোরালি আবার তার যাত্রা শুরু করল। এবারের যাত্রার স্থান পাই ডিস্ট্রিক্ট। ছিয়াংমাই থেকে খুব বেশি দূরে না তবে নোরালি মেইন রোড না ধরে অফ রোড দিয়ে যাবে। মেইন রোড নোরালির পছন্দ না। বড়ই একঘেয়ে। অফ রোড অনেক রোমাঞ্চকর। পথিমধ্যে হঠাৎ সে একটা সাইনবোর্ড দেখতে পেল। এলিফ্যান্ট স্যাংচুয়ারি। চিন্তা করল দেখা যাক এটা কি। গিয়ে বড়ই চমৎকার এবং সুন্দর জায়গা। বিভিন্ন পশু পাচারকারী/শিকারিদের হাত থেকে হাতিদের রক্ষা করে এখানে নিয়ে আসা হয়। তাছাড়া এখানে একটা হাতির প্রজনন কেন্দ্র আছে। তাই বেশ অনেকগুলো বাচ্চা হাতি সেখানে আছে। বাচ্চা হাতিদের সঙ্গে বেশ কিছু সময় কাটিয়ে আর দুপুরের খাবার খেয়ে নোরালি আবার পথে বেরিয়ে পড়ল।
পাইতে একরাত থেকে নোরালি বের হল মায় সারিয়াং এর দিকে। মাঝখানে সে একটু ঘুরে এল বন-কু-সো ব্রিজ, যাকে অনেকে বলে ব্যাম্বো ব্রিজ। ৮০০ মিটার লম্বা এই ব্রিজ পুরোটাই বাঁশের তৈরি। এখানে একটু সময় কাটিয়ে নোরালি আবার মায় সারিয়াং এর দিকে রওনা দিল। পাচ-ছয় ঘন্টা সময় লাগবে কারন নোরালি যাবে অফ রোড ধরে। কিন্তু রাস্তার অবস্থা এতই খারাপ যে এক জায়গায় নোরালি গেল বাইক থেকে পড়ে। ভাগ্য ভাল বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটল না। তবে বাইকের কিছু জায়গায় ক্ষতি হয়ে গেল। কিন্তু এখন কিছুই করার নেই, তাই বাইকটাকে উঠিয়ে নোরালি আবার রওনা দিল।
মাই সারিয়াং গিয়ে নোরালি আটকে গেল। কারন ঝুম বৃষ্টি। বেশ কয়েকদিন টানা বৃষ্টির জন্য আটকে থাকার পর আকাশ পরিষ্কার হতেই নোরালি বেরিয়ে পড়ল। গন্তব্য সুখোতাই। সেখানে কিছু পুরোনো মন্দির সে ঘুরে দেখবে আর রাতে সেখানে থাকবে। মাই সারিয়াং থাকার সময় নোরালি নিজেই তার বাইকের মেরামতের কাজ করল। কারন আসে পাশে তেমন কোন ভাল গ্যারেজ নেই। সুখোতাই থেকে নোরালির পরবর্তী গন্তব্য খাও-ইয়াই ন্যাশনাল পার্ক। সেখানে একটা কটেজে থেকে পরদিন সে চলে এলো আয়ুথায়া। এখানে অনেক পার্ক আর মন্দির আছে। আয়ুথায়া ন্যাশনাল পার্কে ঢোকার মুখে নোরালিকে পার্কের নিরাপত্তা কর্মীরা থামালো। তারা মোটরসাইকেলের সাউন্ড চেক করবে। কারন এই পার্কে বিভিন্ন ধরনের বন্য প্রাণী আছে। অতিরিক্ত শব্দ তাদের বিরক্ত করতে পারে বিশেষ করে বন্য হাতি। তাই একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত শব্দের গাড়ি পার্কের ভেতর ঢুকতে পারে। ভারতে থাকতেই নোরালি বাসন্তীর এক্সজস্ট পরিবর্তন করেছে। তাই এমনিতেই বাসন্তি বেশ কম শব্দ করে। এখানে সেটার একটা পরীক্ষাও হয়ে গেল! পরীক্ষায় পাশ করে নোরালি বাসন্তীকে নিয়ে পার্কের ভেতরে চলে গেল। বেশ অনেকক্ষণ অসম্ভব সুন্দর এই পার্ক ঘুরে রাতের বেলা নোরালি এল আয়ুথায়া শহরে এক হোস্টেলে। সেখানে রাতে থেকে পরদিন সে যাবে ব্যাংকক।
সকালে ঘুম থেকে উঠে নোরালি সময় নিয়ে গোসল সেরে, সকালের নাস্তা খেয়ে আস্তে ধীরে বের হল। কারন আয়ুথায়া থেকে ব্যাংকক মাত্র এক ঘন্টার রাস্তা। সুতরাং তাড়াহুড়ার কিছু নেই। ব্যাংককে পৌছে নোরালি যাবে এক মোটরবাইকের দোকানে। নাম টু হুইল টুরিস্ট। ইউটিউবে নোরালির ভ্রমণের ভিডিও দেখে সেই দোকানের মালিক ইন্সটাগ্রামে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে। বাসন্তীকে সে একটু আপগ্রেড করে দিতে চায়। সমস্যা হয়ে গেল ব্যাংকক ঢোকার মুখে এক হাইওয়ে টোল বুথে। সেখানে তাকে জানানো হয় এই হাইওয়ে দিয়ে মোটরসাইকেল চালানো যায় না। নোরালি পড়ে গেল বিপদে। পুরো হাইওয়েটা ওয়ান ওয়ে। ঘুরে যে অন্য পথ ধরবে সেই উপায় নেই। টোল বুথে থাকা কর্মচারী বেচারা ইংরেজি না জানার কারনে নোরালিকে ঠিক মত বোঝাতেও পারছে না। নোরালি ইশারা ইঙ্গিতে আর ছোট ছোট ইংরেজি বলে বোঝাবার চেষ্টা করছে সে জানত না যে এখান দিয়ে মোটরসাইকেল চালানো যায় না। টোল বুথের কর্মচারী জানতে চাইল তুমি কোথায় যাবে? পাতায়া? নোরালি বলল না ব্যাংকক। তখন সে বলল আচ্ছা তুমি তাহলে সামনে গিয়ে বামে যাবা। কিন্তু সে হাত ইশারা করল ডানে। নোরালি বেশ বিভ্রান্ত হয়ে গেল!! কোথায় যাবে সে ডানে নাকি বামে!! বেশ কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর বেচারা কর্মচারী নোরালিকে চলে যাবার ইশারা করল। নোরালি একটু অবাক হয়ে জানতে চাইল আমি যাব? সত্যি যাব? সে হাত ইশারা করে ভাঙ্গা ইংরেজিতে বলল নো প্রবলেম, গো। নোরালি তার বাইক নিয়ে হাইওয়েতে উঠে গেল।
ব্যাংকক পৌঁছে নোরালি সোজা চলে গেল টু হুইল ট্যুরিস্ট মোটরবাইক শপে। সেখানে গিয়ে সে দোকানের মালিকের সাথে দেখা করে। তার নাম নুই। সে রয়াল এনফিল্ড হিমালয়ানের জন্য কিছু প্রটেকশন অ্যাক্সেসরিস তৈরি করছে। সেগুলো এখনো ডেভেলপমেন্ট পর্যায়ে আছে। পরীক্ষামূলকভাবে সে কিছু তৈরি করেছিল যেগুলো তার মোটরসাইকেলে লাগানো আছে। নুই তার মোটরসাইকেল থেকে খুলে সেগুলো নোরালির বাইকে লাগিয়ে দিল। নোরালি অবাক হয়ে জানতে চাইল ওমা! তুমি তোমার বাইক থেকে খুলে আমাকে দিলে তোমার তো কিছু থাকল না। নুই হেসে বলল ব্যাপার না, আমি আমার জন্য আবার বানিয়ে নিব। শুধু তাই না, নুই একটা জিপিএস ডিভাইস লাগিয়ে দিল নোরালির বাইকে যাতে রুট ব্যাপের জন্য নোরালিকে তার মোবাইল ব্যাবহার করতে না হয়। এত সব অনাকাঙ্খিত উপহার পেয়ে নোরালির হাসি আর থামেই না!!
ব্যাংককে নোরালি কয়েকদিন থাকার চিন্তা করল। এখানে রয়াল এনফিল্ডের অফিসিয়াল ওয়ার্কশপ আছে। নোরালি ভাবল বাইকটাকে ঠিক মত চেকআপ করা দরকার। ভারত থেকে টানা বাইক চালিয়ে সে থাইল্যান্ড এসেছে। মাঝখানে পড়ে গিয়ে কিছু জায়গায় ক্ষতি হয়ে গেছে। যদিও কয়েকবার ছোটখাটো কাজ সে করিয়েছে কিন্তু বাসন্তীর ভাল যতœ দরকার। সঙ্গী যদি সুস্থ না থাকে তাহলে যাত্রাপথে বিপদে পড়তে হবে। ইতিমধ্যে তাদের বিশ্বভ্রমণের প্রায় দুই মাস পার হচ্ছে। দুইদিন ব্যাংকক থেকে নিজের এবং বাসন্তীর জন্য কিছু শপিং করে নোরালি আবার বেরিয়ে পড়ল। এবার তার গন্তব্য দক্ষিণ থাইল্যান্ড। ঘন্টা দুয়েক টানা বাইক চালিয়ে সে চলে এলো খাও সক রয় ইয়ট ন্যাশনাল পার্ক। গালফ অফ থাইল্যান্ডের পাশের এই ন্যাশনাল পার্কে এসে নোরালি অনেকদিন পর সাগরের পাড়ে কিছুক্ষণ সময় কাটালো। সেখান থেকে সে চলে এল আরেকটি স্থানে। পাচওয়াপ খিরি খান। সেখানে সাগর পাড়ের এক হোটেলে রাতের জন্য থেকে গেল।
সকালে নোরালি সিদ্ধান্ত নিল সে আসেপাশের কোন একটা দ্বীপে যাবে। ম্যাপ দেখে সে বের করল যে সাত ঘন্টা বাইক চালালে সে একটা জেটিতে পৌঁছাবে সেখান থেকে একটা ফেরি করে যাওয়া যাবে কো সামুই নামের একটা দ্বীপে। সাত ঘন্টার বাইক রাইড আর দেড় ঘন্টার ফেরি ভ্রমণ শেষে নোরালি পৌঁছে গেল খো সামুই। চমৎকার এই দ্বীপে এসে নোরালি তিন দিন থাকার সিদ্ধান্ত নিল। এখানে সে বিশ্রাম নিবে, ইউটিউবের জন্য ভিডিও বানাবে আর যাত্রার পরবর্তী পরিকল্পনা করব
আরামে তিনদিন দ্বীপে কাটিয়ে নোরালি ফিরে এল থাইল্যান্ডে। ফেরিঘাট থেকে সে চলে এলো খাও স্যাক ন্যাশনাল পার্ক। এখানে সে রাতচাপড়াফা ড্যাম দেখবে আর এই বাঁধ এর কারণে যে লেক তৈরি হয়েছে সেখানে নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়াবে। সেখান থেকে নোরালি চলল খাও সক। রাতের বেলা সেখানেই এক হোটেলে সে থাকবে। খাও সক থেকে নোরালি রওনা দিল ক্র্যাবি। এখানে এসে নোরালি দেখল বাসন্তীর ব্যাক টায়ার প্রায় ক্ষয়ে গেছে। ব্যাংককে বাসন্তীর সার্ভিসিং করার সময় সেখানে টায়ার পাওয়া যায়নি। তাই নোরালি টায়ারের অর্ডার দিয়ে রেখেছে যেটা সে কুয়ালালামপুর থেকে সংগ্রহ করবে। কিন্তু ক্র্যাবি থেকে কুয়ালালামপুর ৯০০ কিলোমিটার। তার মানে নোরালিকে বেশ সাবধানে বাইক চালাতে হবে। অফ রোড গিয়ে এবড়ো থেবড়ো রাস্তা যতটুকু সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। নোরালির কপালে হালকা চিন্তার ভাঁজ!
এবার নোরালির গন্তব্য থাইল্যান্ড-মালয়শিয়া বর্ডার শহর Hat Yai. টিলার উপর একটা ছোট্ট কটেজে নোরালি রাতে থাকার ব্যাবস্থা করল। সেখানে নেই কোন বিদ্যুৎ, নেই ওয়াইফাই। শুধুই নিরবতা। রাতের খাবার খেয়ে নোরালি ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন সকালে সে চলে যাবে মালয়শিয়া।