বাইরে তাকিয়ে দেখি বরফে সাদা হয়ে আছে

রাদিয়া তামিম

ইয়ূসমার্গ। যেখানে গেলে মনে হয় সময় থেমে আছে । আমরা সকালে নাস্তা করে বের হয়ে গেলাম ইয়ূস মার্গের উদ্দ্যেশে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে পৌঁছে গেলাম ইয়ূসমার্গ ভ্যালিতে। যতদূর  চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। এর মাঝে মাঝে ঘোড়া চড়ছে। এখানে ছোট একটি ট্র্যাকিং করে দুধ গঙ্গা নদী দেখতে যাওয়া যায়। আমরা ট্র্যাকিং শুরু করলাম আর আব্বুকে একটি রেস্টুরেন্টে বসিয়ে রেখে গেলাম। পাহাড়ি পাথুরে রাস্তার চারিদিকে সবুজ,  স্নিগ্ধ একটি পরিবেশ। এর মাঝে দল বেঁধে গল্প করতে করতে আমরা হাঁটতে লাগলাম। সঙ্গে যোগ দিলো এক বৃদ্ধ আর তার সঙ্গী ঘোড়া। আমরা ইচ্ছা করলে তার ঘোড়ায় সওয়ার হতে পারি। আমরা যত বলছি আমাদের ঘোড়া লাগবে না তবুও তিনি নাছোড়বান্দা। যাবেনই আমাদের সাথে কি আর করা। এর মধ্যে একটি পাহাড়ি নদী দেখে আমরা নেমে ছবি তুললাম।

যতদূর  চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ

চারিদিকে চুপচাপ নিস্তব্ধ। তার মধ্যে নদী বয়ে যাওয়ার শব্দ অদ্ভুত ভালো লাগলো। এর মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে আমরা কিছুটা ক্লান্ত হয়ে একটি পাথরের  উপর বসলাম। যেখান থেকে নিচে দুধ গঙ্গা নদী দেখা যায়। উপর থেকে দেখতে খুব সুন্দর লাগে আমরা পাথরের উপর বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার ফিরে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হলাম সঙ্গে সেই বৃদ্ধ আর তার ঘোড়া। এর মধ্যে আমাদের এক সদস্যের হঠাৎ কোমরের ব্যথা শুরু হলো। অগত্যা কি আর করা। ওঠো বৃদ্ধার ঘোড়ায়। এখন মনে হল ভাগ্যিস বৃদ্ধা তার ঘোড়া নিয়ে সঙ্গে ছিল। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়া শুরু হলে আমরা চিন্তায় পড়ে গেলাম। পাহাড়ি রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে গেলে হাঁটতে খুব অসুবিধা হবে তাই জোর কদম চললাম।

পৌঁছে দেখি আব্বু রেস্টুরেন্টে বসে চা খাচ্ছে আমরাও আব্বুর সঙ্গে যোগ দিলাম এই ঠান্ডার মধ্যে গরম গরম চা খুব আরামদায়ক লাগলো। চা খেয়ে শ্রীনগরের পথে রওয়ানা হলাম। এবার যাবো জামে মসজিদ। কথিত আছে এই মসজিদে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর চুল সংরক্ষিত আছে। ঝিলাম নদীর পাড়ে খুব সুন্দর জায়গায় মসজিদটি অবস্থিত । মসজিদের বাইরে হালুয়া রুটির দোকান। এক একটি রুটি এক কেজি আটা দিয়ে বানানো হয়। সে দেখার মতো ব্যাপার। আমরা রুটি হালুয়া কিনে খেলাম। বেশ সুস্বাদু খেতে।

এক একটি রুটি এক কেজি আটা দিয়ে বানানো হয়

শ্রীনগর শহরটি আর দশটি মফস্বল শহরের মত, নেই কোন আধুনিকতার ছোঁয়া। আমরা হোটেলে ফেরার পথে কিছু দোকানপাটে ঘুরলাম, তারপর ডিনার করতে ঢুকলাম এক রেস্টুরেন্টে। যারা কাশ্মীরি খাবার পরিবেশন করেন। খাবারের থালায় পোলাও আর তার চারপাশে বিভিন্ন পদের মাংসের কাবাব। এর নাম ওয়াজ ওয়ান। ওদের বিয়েতে এই খানা খাওয়ানো হয়। আমার অত ভালো লাগেনি। বেশ গরুপাক। খাবার খেয়ে হোটেলে রওনা হলাম পরের দিনের গন্তব্য গুলমার্গ । আইস স্পোর্টস এর জন্য বিখ্যাত গুলমার্গ। শীতকালে বিদেশিরা ভিড় করে স্কি করার জন্য আর আছে রোপওয়ে। বরফের উপর দিয়ে নিয়ে যাবে বরফের রাজ্যে। তবে বেশিরভাগ সময় আবহাওয়া খারাপ থাকে তাই ভাগ্য সুপ্রসন্ন না থাকলে এর ওপরে উঠা যাবে না । তাই আমরা হোটেলে মালপত্র রেখে দৌড় দিলাম রোপ ওয়ে উঠার জন্য। কিন্তু কপাল খারাপ। আবহাওয়ায় খারাপ হওয়ায় রোপওয়ে বন্ধ, ফিরে চললাম হোটেলে।

আব্বু এর মধ্যে ফ্রেশ হয়ে রুমে হিটার চালু করে বিছানায় শুয়ে পড়েছে। বলল, খুব আরাম লাগছে, বাইরে বেশ ঠাণ্ডা। আমরা ঠিক করলাম বিকেলে আবার ট্রাই করবো এখন আপাতত দুপুরের খাবারের অর্ডার করি। নিচে নেমে দেখলাম একটি পরিবার তাদের আট নয় বছরের বাচ্চাকে কোলে করে ঢুকেছে আর বাচ্চাটার মা খুব চিৎকার করছে। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতে বলল উপরে ঝড়ের মধ্যে পড়েছিল আর বাচ্চাটা বরফে আছার খেয়েছে। আমরা তাড়াাতাড়ি বাচ্চাটাকে সোফায় শুইয়ে দিলাম আর মাকে বললাম মোজা খুলে পা মেসেজ করতে। আমরা গেলাম গরম দুধের ব্যবস্থা করতে। যাক কিছুক্ষণ পর বাচ্চাটা স্বাভাবিক হলো। ওরা কলকাতা থেকে এসেছে আজকেই চলে যাবে। আমরাও লাঞ্চের জন্য রওনা হলাম। ভাত আলু আর মুরগির তরকারি। আজকের দুপুরের খাবার।

ইয়ুসমার্গ

বিকেলে আবার গেলাম রোপওয়েতে চড়তে। কিন্তু আজকের মত বন্ধ হয়ে গেছে রোপ ওয়ে। কি আর করা ভাবলাম ঘোড়ায় চড়ে জায়গাটা দেখি। আমি আর একজন ঘোড়া ভাড়া করলাম। ওরা আমাদেরকে নিয়ে চলল বরফের রাজ্যে। পাহাড়ি পথ, ঝরনার মধ্যে দিয়ে চলছি। মনে হচ্ছে ওয়েস্টার্ণ সিনেমার কোন নায়িকা নায়কের খুঁজে যাচ্ছি। যেখানে নিয়ে গেল জায়গাটি আহামরি কিছু না। তবে যাওয়ার পথটা বেশ অ্যাডভেঞ্চারাস। ফিরে এসে দেখি আব্বু হাঁটতে বের হয়েছে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে আর ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। আমরা হোটেলে ফিরে চললাম। গুলমার্গ প্রধানত একটি ট্যুরিস্ট স্পট। একে ঘিরে শহরটি গড়ে উঠেছে। সন্ধ্যার পর চারিদিক সুনসান হয়ে পড়লো। মনে হল রূপকথার গল্পের মতো নির্জন এক পাহাড়ি গ্রামে এক ঘরে বন্দি হয়ে আছি। সকালে ঘুম থেকে উঠে আমাদের জন্য আরেক বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। বাইরে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি বরফ পড়ে চারিদিক সাদা হয়ে গেছে। অদ্ভুত ভালো লাগায় মন ভরে গেল।

চলবে.....

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন