নোরালির বিশ্ব ভ্রমণ (পর্ব-১)

শোয়ায়েব চমক

আচ্ছা বলুন তো কে প্রথম বিশ্ব ভ্রমণ করেছিলেন? ইতিহাস ঘাটলে জানা যায় ১৪৮০ সালে জন্মানো পর্তুগীজ ভু-পর্যটক ফার্দিনাল ম্যাগলান ১৫১৯ সালে স্পেন থেকে পাঁচটি জাহাজ নিয়ে ইন্দোনেশিয়ার স্পাইস দ্বীপপুঞ্জের দিকে যাত্রা শুরু করেন। তিনি এক সমুদ্রপথ আবিষ্কার করেন যা বর্তমানে “Strait of Magellan” নামে পরিচিত। ম্যাগলান প্রথম ইউরোপীয় পর্যটক যিনি স্পেন থেকে যাত্রা শুরু করে প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়েছিলেন।  আমি আজকে আপনাদের ম্যাগলানের গল্প বলব না। আগামী কয়েক পর্বে আপনাদের শোনাবো এক আধুনিক ভূ-পর্যটকের গল্প। তার নাম নোরালি সুমাখার। বিশ্বভ্রমণে তার সঙ্গী একটি মোটরসাইকেল আর কয়েকটি GoPro ক্যামেরা।

১৯৮৮ সালের মে মাসে নেদারল্যান্ডস এর রটারডামে নোরালির জন্ম। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মানো নোরালির বাবা একটি হার্ডঅয়্যার দোকানের মালিক। মা গৃহিণী। রটারড্যামে স্কুল এবং কলেজ শেষ করে নোরালি চলে আসে আমস্টারডামে ভূ-রসায়ন নিয়ে পড়াশুনা করতে। ইউনিভার্সিটি অফ আমস্টারডামে জিওক্যামিস্ট্রির উপর মাস্টার্স শেষ করে নোরালি চলে যায় অস্ট্রেলিয়ায় তার পিএইচডি রিসার্চের অংশ হিসেবে জিওক্যামিক্যাল স্যাম্পল সংগ্রহ করতে। কথা ছিল সে স্যাম্পল নিয়ে চলে আসবে আমস্টারডাম। কিন্তু তার পরিবর্তে নোরালি সেখানকার এক স্বর্ণ খনিতে ভূতাত্ত্বিক জরিপের পরিদর্শক হিসেবে এক বছর কাজ করে। এই কাজে সে বিপুল পরিমান বেতন পেত যার প্রায় পুরোটাই নোরালি জমিয়ে রাখত। এক বছর কাজ করার পর নোরালি স্বর্ণখনির চাকরি ছেড়ে দিয়ে জমানো সব টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে দেশ ভ্রমণে। দুই বছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে কপর্দশুন্য হয়ে নোরালি চলে আসে নেদারল্যান্ডস তার বাবা মার কাছে।

নোরালি এক আধুনিক ভূ-পর্যটক 

এর পর পরবর্তী পাঁচ বছর আন্তর্জাতিক কনট্রাক্টর হিসেবে নোরালি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জিওলজিক্যাল প্রজেক্টে কাজ করেছে। এর মধ্যে বাহামা, ব্রাজিল, কুয়েত, কাজাকিস্তান, মরক্কো উল্লেখযোগ্য। কিন্তু নোরালির ইচ্ছা দীর্ঘমেয়াদে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ানো। চাকরি করে সেটা সম্ভব না। ইতিমধ্যে গত পাঁচ বছরে সে আবারো বেশ কিছু টাকা জমিয়েছে। এবার আর কোন দিকে না তাকিয়ে নোরালি চাকরি ছেড়ে আবার নেদারল্যান্ডস এ বাবা মার কাছে চলে আসে। সেটা ২০১৫ সাল। নেদারল্যান্ডস এসে নোরালি মোটরবাইক লাইসেন্স নেয় এবং একটা সেকেন্ড হ্যান্ড ডুকাটি মনস্টার ৭৯৬ বাইক কিনে ফেলে। সেটা নিয়ে সে নেদারল্যান্ডস এর এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতে থাকে। এর মধ্যে নোরালি তার পরিকল্পনা শুরু করে বিশ্বভ্রমনের। দীর্ঘমেয়াদী বিশ্বভ্রমনে টাকার প্রয়োজন। এই জন্য সে তার নেদারল্যান্ডস এর বাড়ী আর মোটরসাইকেলটি বিক্রি করে দেয়।

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর নোরালি চলে আসে ভারতে। এখানে এসে সে একটা মোটরসাইকেল ভাড়া করে। রয়াল এনফিল্ড হিমালয়ান। সেটা নিয়ে হিমাচল প্রদেশ, জম্মু-কাশ্মির, লাদাখ, কারগিল সহ প্রায় তিন হাজার মাইল সে ঘুরে বেড়ায়। এই মটরসাইকেলটা নোরালির এতই পছন্দ হয় যে সে ভারত থেকেই একটা নতুন রয়াল এনফিল্ড হিমালয়ান কিনে ফেলে। যদিও নোরালি একাই বিশ্বভ্রমন করতে পছন্দ করে। কিন্তু মোটরসাইকেলটা তো তার প্রতিদিনের সঙ্গী। তো সঙ্গীর একটা যুতসই নাম দরকার!! নোরালির ভারতীয় বন্ধুরা পরামর্শ দিল এর নাম হবে ‘বাসন্তি’। নোরালি অবাক হয়ে জানতে চাইল বাসন্তি কেন? ভারতীয় বন্ধুরা নোরালিকে শোলে ছবির গল্প বললো। সব শুনে নোরালির বাসন্তি নামটা খুবই পছন্দ হল। এভাবেই শুরু হল নোরালি এবং বাসন্তির ভারত থেকে বিশ্বভ্রমণ।

নোরালি এবং বাসন্তি

২০১৮ সালের ডিসেম্বর এর শুরুর দিকে ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে নোরালির বিশ্বভ্রমনের প্রথম অধ্যায় এর প্রথম পর্ব শুরু হয়। এই পর্বে তার রুট ম্যাপ হচ্ছে ভারত-সিকিম-মায়ানমার-থাইল্যান্ড-মালয়শিয়া।  এখানে বলে রাখা ভাল, ভারত থেকে নোরালি যে নতুন মোটরসাইকেল কিনেছে যার নাম বাসন্তি। এটা কিন্তু নোরালি নিজের নামে কিনতে পারেনি। কারন ভারতীয় পাসপোর্ট না থাকাতে নোরালি বাসন্তীকে নিজের নামে ভারতে রেজিস্ট্রেশন করতে পারবে না। আর রেজিস্ট্রেশন না করলে এই বাইক সে ভারত থেকে বের করতে পারবে না চালাতেও পারবে না। এক ভারতীয় বন্ধু তার নিজের নামে বাসন্তীকে রেজিস্ট্রেশন করে মোটরসাইকেলটি নোরালিকে ব্যাবহারের জন্য নো অবজেকশন সার্টিফিকেট দিয়ে দেয়। নোরালির ভয় ছিল এই মোটরসাইকেল নিয়ে ভারতের বাইরে যে ভ্রমণ করতে পারবে কিনা। বিভিন্ন কাগজপত্র নিয়ে সরকারী অফিসে মাসখানেক দৌড়াদৌড়ি করার পর অবশেষে বাসন্তীকে ভারতের বাইরে নেবার অনুমতিপত্র পাওয়া গেল।

সরকারি অনুমতিপত্র পাবার পরদিনই নোরালি বেরিয়ে পড়ল তার দীর্ঘমেয়াদী বিশ্বভ্রমণে। দিল্লি থেকে মথুরা, লখনউ, ভারানাসি, পাটনা হয়ে বৈশালি এসে নোরালি একটা ছোট্ট কটেজে দুইদিন বিশ্রাম করে। বৈশালী থেকে দীর্ঘ ১১ঘন্টা বাইক চালিয়ে সে চলে আসে শিলিগুড়ি পার হয়ে দার্জিলিং মুক্ত বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নেবার জন্য। দার্জিলিং এসে পরদিন লাগেজ হোটেলে রেখে নোরালি রওনা দিল সিকিমের উদ্দেশ্যে। বর্ডারে গিয়ে একদিনের জন্য অনুমতি নিয়ে সিকিম ঘুরে রাতেরবেলা নোরালি আবার ফিরে আসে দার্জিলিং। পরদিন নোরালি রওনা দিল কুচবিহার, এক রাত থেকে সে চলে এলো মেঘালয় এর তুরা এলাকায়। সেখানে একটা ট্রি হাউসে রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে চলে গেল শিলং। এখানে নোরালি তার বাসন্তীর কিছু সার্ভিসিং এর কাজ করে যেমন ওয়েল ফিল্টার চেঞ্জ, ব্রেক চেক ইত্যাদি। এর মাঝে সে এক ফাঁকে চেরাপুঞ্জিও ঘুরে আসে।

ভারত ভ্রমণে নোরালি

শিলং থেকে পরদিন নোরালি রওনা দিল নাগাল্যান্ডের দিকে। কিন্তু শিলং থেকে নাগাল্যান্ড অনেকদূর তাই নোরালি ঠিক করল সে একরাত মাঝখানে কোথাও থাকবে। এলো আসামের একটা ছোট শহর লঙ্কায়। সেখানে রাতে থেকে পরদিন সকাল সকাল রওনা দিয়ে সে চলে আসল নাগাল্যান্ড। যতদূর সে জানত যে নাগাল্যান্ডে ঢোকার আগে পুলিশের অনুমতি নিতে হয়, কিন্তু নাগাল্যান্ডের বর্ডার দিয়ে ঢোকার সময় কোন পুলিশ না থাকাতে অন্যান্য গাড়ির সাথে নোরালিও ঢুকে গেল। একরাত সেখানে থেকে নোরালি রওনা দিল মনিপুর। মজার ব্যাপার হচ্ছে নাগাল্যান্ড থেকে মনিপুর ঢোকার সময় নোরালিকে পুলিশ থামায় এবং প্রশ্ন করে নাগাল্যান্ডে সে কিভাবে ঢুকল। নোরালির ব্যাখ্যা শুনে পুলিশ আর কিছু না বলে তার পাসপোর্টে মনিপুর রাজ্যে থাকার জন্য পাঁচ দিনের অনুমতি দিয়ে স্ট্যাম্প মেরে দিল। মনিপুরের ইমফল শহরে সেদিনের মত নোরালি তার যাত্রা শেষ করে।

নোরালি এবার রওনা দিল মিয়ানমারের কাছের শহর মোরে এর দিকে। ইমফাল থেকে মোরে যাবার পথে এক পাক ঘুরে এল লকটাক লেক। মোরে তে রাতেরবেলা এক বিচ্ছিরি নোংরা হোটেলে (টয়লেট কাজ করে না, রাত বেশী হওয়ায় এবং অন্য কোন হোটেল খোঁজার মত এনার্জি না থাকায়) রাত কাটিয়ে নোরালি তার ভারত ভ্রমণ শেষ করল। কারণ পরদিন সে বর্ডার পার হয়ে মিয়ানমার চলে যাবে।

 

 

(চোখ রাখুন আগামী পর্বে)

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন