জৌলুস হারিয়েছে বেতিলা জমিদারবাড়ির

কালীগঙ্গা আর ধলেশ্বরী নদী মানিকগঞ্জের প্রাচীন সভ্যতাকে ধারন করে খরস্রোতা নদী হিসেবে প্রাচীনকাল থেকেই বয়ে চলেছে। যদিও এখন সেই নদীকে দেখে বোঝার অবকাশ নেই। বর্তমানে অনেক স্থানে নদী শুকিয়ে গেছে, ভরাট হয়ে চাষাবাদ হচ্ছে। তবে সেই শতবছর আগে একসময় ছিল মানিকগঞ্জ শত শত জমিদার আর ব্যবসায়ীদের স্বর্গরাজ্য।  এজন্য এখনও মানিকগঞ্জের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেই স্বর্ণযুগের ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত প্রাচীন শহর, বন্দর, বর্ধিষ্ণু জনপদ, পুরার্কীতির স্থাপত্যের অস্তিত্ব, যদিও এর অনেকটাই এখন স্থানীয় জনগনের দখলে হারাতে বসেছে এবং ইতিমধ্যে অনেককিছুই হারিয়ে গিয়েছে। আর আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের প্রাচীন ইতিহাস আর স্থাপত্যের নির্দশনগুলো। কাজের ফাঁকে আমার নেশা অজানা সেই ইতিহাসকে খুঁজে ফিরে দেখা। ইতিহাসের সেই সমৃদ্ধজনপদ দেখতে একদিন গেলাম মানিকগঞ্জের বেতিলাতে। উদ্দেশ্য বেতিলা জমিদারবাড়ি দেখা।

জমিদার বাড়ীর সম্মুখভাগ 

মানিকগঞ্জের এই বেতিলাতে দুই বিখ্যাত নদী কালীগঙ্গা আর ধলেশ্বরীকে যুক্ত করেছে বেতিলা খাল। স্থানীয়দের মুখে জেনেছি একসময় এই খাল ছিল গভীর আর স্রোতস্বিনী আর একারনেই সে সময়ের বিখ্যাত ধনী বণিক জ্যোতি বাবু এবং সত্য বাবু এই নিরাপদ নৌরুট বেছে নিয়েছিলেন এই বেতিলাতে। ছিমছাম সবুজ ঘেরা গ্রাম বেতিলা, যার মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে এই বেতিলা খাল। একসময় জলে পরিপূর্ণ এই বেতিলা খাল দিয়ে বয়ে যেত নানান বজরা, মহাজনী নৌকা। তারা নৌকা ভরে পাট এবং অন্যান্য মালামাল নিয়ে আসা যাওয়া করতো ধলেশ্বরী আর কালিগঙ্গার নদীর পথ ধরে। স্থানীয় লোকজনের মুখে আর এখনকার বসবাসরত বাসিন্দাদের কাছ ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, জ্যোতি বাবু ছিলেন কলকাতার বণিক, যিনি এই জমিদার বাড়ির পূর্বপুরুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন মূলত পাটের বণিক, পাটের জন্য বাংলাদেশের খ্যাতি এখন শুধু ঐতিহ্য। প্রাচীন বাংলায় এই বাংলাদেশ থেকে শুধুমাত্র পাটের বাণিজ্য করেই জমিদারদের মতো সম্পদশালী হয়েছেন বহু বণিক। আর এই এলাকার পাটের ব্যবসায়ের সুবিধার কারণে এ অঞ্চলে জ্যোতি বাবু এবং সত্য বাবু মত বণিকদের আগমন ঘটে বলে ধারণা করা হয়।

জ্যোতি বাবুর কলকাতার পাটের ব্যবসার এখানে সম্প্রসারণ করেন এবং বেতিলাতে তার বসতবাড়ি হিসেবে এই বেতিলা জমিদার বাড়ি তিনি বেতিলা খাল ঘেঁষে তৈরি করেন  সেসময়ে। সেসময়ের অজপাড়াগাঁয়ের এই বিশাল দালান কোঠা, শান-শওকত স্থানীয়দের কাছে জমিদারী হিসেবে পরিচিত হয়। যার ফলে, তার বসতবাড়িটি জমিদার বাড়ি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। লোকমুখে জানা যায় জ্যোতি বাবু মৃত্যুর আগে তাঁর ওয়ারিশদের কাছে এই জমিটি সঠিকভাবে প্রদান করতে পারেনি বলে বর্তমানে সরকার এই বাড়িটি অধিগ্রহণ করেছে। একসময় এখানে এতিমদের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে পরিচালিত হলেও ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ায় তাদের সরিয়ে নেয়া হয়। বর্তমানে দেখভালের জন্য একজন সরকারী কর্মকর্তা পরিবারসহ এখানে বাস করেন। এখানে দুটো পাশাপাশি ভবন রয়েছে। গাছগাছালি দিয়ে ঘেরা ছায়া-সুনিবিড় এই বাড়িটির সৌন্দর্য অন্য কোনো জমিদার বাড়ির চেয়ে কম নয়। জমিদার বাড়িটি দেখলেই বোঝা যায় সেসময় কি পরিমাণ জৌলুস ছিল এই বাড়িতে। সেই আগের জৌলুস এখন না থাকলেও এর সৌন্দর্য সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায়নি। সরকারী ব্যবস্থাপনায় থাকলেও এর অবস্থা খুব শোচনীয়, এখন পর্যন্ত এর স্থাপনা যথেষ্ট মজবুত থাকলেও অযতœ অবহেলার ছাপ স্পষ্ট দেখা যায় বাড়িটিতে।

খিলানযুক্ত বারান্দা

 

ঢাকা থেকে আরিচাগামী বাসে করে মানিকগন্জের সদরে নেমে সেখান থেকে লোকাল বাসে যেতে হবে বেতিলা পর্যন্ত। বেতিলাতে ইজি বাইক করে বেতিলা জমিদার বাড়ি যাওয়া যাবে। রাস্তা বেশ সড়ক তবে পাকা সড়ক এবং শেষ দেড় কিলো রাস্তা খারাপ। প্রাইভেট কারে যাওয়া বেশ দুরূহ। 
এভাবে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক প্রাচীন স্থাপনা আর নির্দশন। এই নির্দশনগুলো যদি সঠিকভাবে আমরা প্রতœতত্ব বিভাগ আর পর্যটন মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে সংরক্ষণ এবং দেশী-বিদেশী পর্যটকদের কাছে তুলে ধরতে পারি তাহলে একদিকে যেমন স্থানীয় অর্থনীতি আরো সচল এবং বেগবান হবে। অন্যদিকে নিজের দেশকে আমরা আরও সুন্দরভাবে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে পারবো। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে জাতি তার ইতিহাস ভুলে যায় তার বর্তমান এবং ভবিষৎ উভয়ই মূল্যহীন। তাই আসুন এধরনের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নির্দশনগুলো আমরা সামাজিকমাধ্যমে তুলে ধরি এবং দেশকে ভালোবাসি।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন