৪ কন্যার সিকিম ভ্রমণ

মাহফুজা আক্তার

শুধু চারজন মেয়ে! কোন ছেলে নেই সঙ্গে! এত্ত সাহস! পাগলে পেয়েছি নাকি যে মেয়েরা এভাবে কোন অভিভাবক ছাড়া বিদেশ যায়? অচেনা অজানা জায়গা নানান ঝুঁকি। কোন ঝামেলা হলে কেমনে কি করবি? এই বাক্যগুলো দিয়ে অনেকেই আমাদের বারবার জানিয়ে দিতে চেয়েছে আমরা মেয়ে! পরিবার বা অভিভাবক ছাড়া আমাদের বাইরে যাওয়া ঠিক না। তবে এসব সমালোচনা আমরা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিয়েছি বহুবার, বহুভাবে। বেশ কয়েকদিন ধরে চার বান্ধবী এখানে ওখানে ঘুরতে যাব ঠিক করেছি। কিন্তু কোথায় যাব এই ভাবনা থেকে ঠিক করলাম এবার আর দেশ নয় দেশের বাইওে কোথাও যাব। দেশতো অনেক দেখা হল এবার একটা ট্রিপ তো দেশের বাইরে হতেই পারে। ১৫ বছরের বন্ধুত্বের দেয়ালে আরও রঙিন কিছু স্মৃতির ইট জমাতেই মূলত এই পরিকল্পনা। আমরা চারজন নিজেরাই পরিকল্পনা করে কোন এজেন্সির সাহায্য ছাড়া সিকিম যাচ্ছি শুনে অনেকের মাথায় হাত। কিন্তু আমরা দস্যি। সমালোচনা আমদের কাছে নস্যি।

৪ কন্যা

শুরু হল প্রস্তুতি। আমার, নিপা ও জোহরার পাসপোর্ট থাকলেও নাঈমার পাসপোর্ট নেই। এদিক-সেদিক যোগাযোগ করে অবশেষে পাসপোর্ট হাতে পেলাম চারমাস পর। এবার শুরু হল ভিসা নিয়ে ঝামেলা। অবশেষে তাও মিটল। এবার যাওয়ার তারিখ ঠিক করার পালা। ফেব্রুয়ারির ৬ তারিখ থেকে দুদিন অফিস বন্ধ আছে। ভাবলাম এই সুযোগে আর কটা দিন ছুটি নিয়ে ট্যুরটা সেরে ফেললেই হয়। যেই ভাবা সেই কাজ। টিকিট কেটে ফেললাম শ্যামলী এসি বাসের। ভাবলাম ৫ তারিখে পাসপোর্ট হাতে পেলে পাব, না পেলে পঞ্চগড় ঘুরে চলে আসব। তবে এবার যাব-ই। নিপা পাকা হিসাবরক্ষকের মত হিসাবের ও পরিকল্পনার জন্য এক্সেল শিট নামিয়ে নিল মোবাইলে। সিকিম ভ্রমণের ওপর বেশকিছু ভিডিও দেখলাম। ভিসা, পাসপোর্ট সব ঠিকঠাক হাতে পেয়েছি। সেখান থেকে রওনা দিয়ে বাসায় আসতে আসতেই সন্ধ্যা। রাত ৯টায় বাস। কোনমতে গোসল সেরে ব্যাগ নিয়ে দৌড় শ্যামলীতে। প্রথম দিন : শ্যামলী এসি বাসে রওনা দিয়ে বাংলাবান্ধা, সেখান থেকে ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে বর্ডার ক্রস করলাম। ওপাড় ফুলবাড়িতে ইমিগ্রেশন শেষ করে মজুমদার ট্রেডার্সে টাকা ভাঙিয়ে রুপি করে করে নিলাম। তারপর টোটোতে করে শিলিগুড়ি। সেখান থেকে প্রাইভেট সোমো গাড়ি নিয়ে গ্যাংটক। খরচ হলো ১৮২০ রুপি। পথে র‌্যাংপোতে নেমে ইনার পারমিট নিয়ে নিলাম। সেদিন হোটেল গোল্ডেন নেস্ট-এ চেক ইন করে রাতে শুধু গ্যাংটক এবং এমজি মার্ক ও এর আশপাশে রাতের শহর দেখেছি। দ্বিতীয় দিন: এদিন শুরুতে ২২০০ রুপিতে গাড়ি রিজার্ভ করে নিলাম। শুরুতেই একটি ওয়াটার ফল যা কিনা আমাদের এখানে ঝর্না তা দেখলাম। অত আহামরি কিছু লাগেনি। কারণ, ওদের রাস্তার পাশেই অনেক ঝর্না। তারপর বানজার্কি ওয়াটার ফল। প্রথমটির চেয়ে এটা অনেক সুন্দর। এখানে যাওয়ার পথে অনেক কিছুই চোখে পড়লো। এখানকার ওয়াটার ফলটি অনেক সুন্দর আর পানির স্রোত অনেক বেশি। তারপর লিংদম মোনাস্ট্রি।

লিংদম মোনাস্ট্রি

পরপর দেখা এই দুটি স্থানই অস্থির রকমের সুন্দর। এরপর আমরা প্লান্ট কনজারভেটরিতে গেলাম। আশি রুপিতে ভেতরে প্রবেশ করে হতাশ হয়েছি। আহামরি কিছু না। কারণ, সব গাছের ফুল পাতা কিছুই পাইনি। হনুমানটঙ্কেও গিয়েছি। এখান থেকে পাহাড়ের দৃশ্য ছিল অসাধারণ সুন্দর। মাঝে আরো দুটো মন্দির ও ভিউ পয়েন্ট পড়েছে। তারপর গেলাম ফ্লাওয়ার এক্সিভিশন বা ফুলের প্রদর্শনীতে। হাজার রকমের ফুল। যাদের ফুলের সুবাস ও ফুল ভালো লাগে তারা খুবই উপভোগ করবে এই স্থানটি। তারপর ছিল রোপওয়েতে চড়া। রোপওয়েতে ক্যাবলকারে পুরো গ্যাংটক শহর উপর থেকে দেখা যায়। যারা আগে কখনো ক্যাবল কারে উঠেনি তাদের ভালো লাগবে এখানে। তৃতীয় দিন: এই দিনটি লাচুং ভ্রমণ। এই ট্রিপে আমরা গাড়িতে আরও নতুন দুজনকে সঙ্গী করেছি। ৬/৭ জনের একটি গাড়ি নিয়েছি ১৩০০০ রুপিতে। এ গাড়িটা আমরা ঠিক করেছি সানফ্লাওয়ার এর মাধ্যমে। ওরা আমাদেরকে সিকিম এর ইনার পারমিট নিয়ে দিয়েছে। সাথে লাচুং এর সানফ্লাওয়ার হোটেলে ছয়জনের জন্য ৩ রুম, দু বেলা লাঞ্চ, একবেলা বিকালের নাস্তা, একবেলা সকালের নাস্তা, একবেলা রাতের খাবারও দিয়েছে। আর এই সবমিলে ছয়জনের খরচ দাঁড়াবে ১৩০০০ রুপির মধ্যেই। লাচুং যাওয়ার পথে সেভেন সিস্টার ওয়াটার ফলস ছিল অসাধারণ সুন্দর। কিন্তু পথে ব্রিজের কাজ হচ্ছে তাই আমাদের খুব কাছে যেতে দেয়া হয়নি। চুনথাং জয়গাটি ছিল অস্থির রকমের সুন্দর। এখান থেকে বরফ গলা নদী তিস্তা ও তিস্তার বাঁধ সঙ্গে পাহাড়ের দৃশ্য অপরূপ সুন্দর। ইয়াংকসা গেটটি আছে মোটামুটি। এখানেও নেমেছি আমরা।

বরফ গলা নদী তিস্তা

পথে আর কোথাও নামিনি। উদ্দেশ্য যত আগে লাচুং পৌঁছাতে পারি। যেতে যেতে খুব করে চাচ্ছিলাম যাতে স্নো ফল পাই। আল্লাহ যেন শুনেছে মনের কথা। সানফ্লাওয়ার হোটেলের সামনে পৌঁছে গাড়ি থেকে নামতেই দেখি স্নো ফল শুরু হয়ে গেছে। মাইনাস চার ডিগ্রি চলছে তখন লাচুং-এ। স্নো ফল দেখতে পেয়ে মনে হলো জীবনে আর কোন সাধ নেই। সব সাধ পূরণ হয়ে গেছে। আর আমাদের রুমের জানালা দিয়ে পাহাড়ের অপূর্ব দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল। সেই সঙ্গে পূর্ণ চাঁদ ষোলকলা পূর্ণ করে দিল। চতুর্থ দিন: এদিন সকালে উঠেই চলে গেলাম ইয়ামথাং ভেলিতে। তাপমাত্রা ছিল মাইনাস ১৩ ডিগ্রিতে। চারদিকে শুধু বরফ আর বরফ। সারা গায়ে বরফ মেখে সেখান থেকে গ্যাংটক ফেরার পথে নেমেছি বরফ গলা নদী তিস্তাতে। পানিগুলো একদম নীল, স্বচ্ছ। এত্ত ভাল্লাগে দেখতে। তারপর সন্ধ্যায় এসে পৌঁছেছি গ্যাংটক শহরে। যথারীতি হোটেল গোল্ডেন নেস্টে।

 ইয়ামথাং ভ্যালি

আমাদের এবারের ভ্রমণের ইতি টানার সময় হয়ে এল। সকালে উঠেই ১০টার বাসে উঠলাম এসএনটি থেকে। গানের কলি নিয়ে খেলতে খেলতে পৌঁছে গেলাম শিলিগুড়ি। তারপর টোটো নিয়ে ফুলবাড়ি বর্ডারে। এখানে আবার এক্সিট পার্মিট, কাস্টমসের কাজ শেষ করে বর্ডার ক্রস করে বাংলাবান্ধা। কাস্টমসের কাজ শেষ করে খাবার হোটেলে গেলাম। চারজনে ডিম, আর সবজি দিয়ে ভাত খেয়ে মনে হলো কতদিন যে ভাত না খেয়ে আছি। শ্যামলী পরিবহনের বাস বাংলাবান্ধা থেকে ছাড়লো সন্ধ্যা ৭টায়। ৬ষ্ট দিন: সকাল ৯টা পৌঁছে গেলাম শ্যামলী। বর্ডার ও অন্যান্য সব জায়গায় সবার একটাই প্রশ্ন ছিল শুধু ৪টা মেয়ে? বিয়ে করো নি এখনো? অবিবাহিত? ঐ যা হোক শেষ করি খরচের হিসেব দিয়ে। আমাদের জনপ্রতি খরচ হয়েছে ১১,০০০ টাকা। শেষ কথা: আরেকটু বলি, সিকিম শহরটা অনেক পরিষ্কার। সেখানে কেউ পথে-ঘাটে যত্রতত্র ময়লা, থুতু ফেলেনা। নর্থ সিকিমে প্লাস্টিকের পানির বোতল নিয়ে যাওয়া নিষেধ। বাজার করার ক্ষেত্রেও ওরা চটের ব্যাগ ব্যাবহার করে।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন