১৯ হাজার টাকায় ১৯ দিনের ভারত ভ্রমণ (পর্ব-২)

ফাহিম কবীর

 

কলকাতা টু জম্মু ভায়া দিল্লি

 

কালকা মেইল-১২৩১২

 

২৯ তারিখ ঠিক সন্ধ্যা ৭ টা বেজে ৪০ মিনিটে ট্রেন নড়ে উঠলো । বুঝলাম হাওড়া ছাড়ার সময় হয়ে গেছে । আমরা দুই বন্ধু আমাদের নিজেদের আসনে বসে গেলাম । সবকিছু এতো সুন্দরভাবে হয়ে গেলো বলে খুব ভালো লাগছিলো । কলকাতা থেকে দিল্লি প্রায় ১৪৫০ কিলোমিটার । এই দূরত্ব অতিক্রম করতে কালকা মেইলের সময় লাগে প্রায় ২৫ ঘণ্টা । ট্রেন ছুটে চলছে, সেই সাথে চলছে আমাদের ক্রমপরিবর্তনশীল ট্যুরের প্ল্যানিং । ইন্ডিয়ার ট্রেনগুলোতে ভ্রমণ করতে আমার বরাবরই অসম্ভব ভালো লাগে । শুয়ে, বসে, আলস্যে, গল্পে, আড্ডায় পার হয়ে যায় সময়গুলো । এতো লম্বা সময়ে সহযাত্রী মানুষগুলোর সাথেও তৈরি হয় সখ্যতা । প্রতিটি ট্রেন ভ্রমণই আমার কাছে একেকটি গল্পের ঝাঁপি । ভালো লাগে ব্যাপারগুলো ।

জম্মু-তাওয়াই

যাহোক, গল্প সেদিনের মতো শেষ করে ঘুম দিলাম দুই বন্ধু । শেষ রাতে উঠে পার্সেল করে আনা খাবারটা খেয়ে নিলাম । এরপরে ফের ঘুম । এক ঘুমে সকাল দশটা । ঘুম ভেঙ্গেই বরং বিপদে পড়ে গেলাম । ট্রেন তখন বিহারের ভেতরে দিয়ে ছুটে চলেছে । আবহাওয়া মোটেও অনুকূলে মনে হচ্ছিলো না। বেশ গরম পড়ে গেছে । অমনিই নিজের সিটে পড়ে রইলাম । দুপুর হয়ে এলে আর শুয়ে থাকতে পারছিলাম না । উঠে বসলাম, ফ্রেশ হলাম ।

 

উত্তর প্রদেশের সময়গুলোঃ(৩০/০৫/১৯)

বিকাল হয়ে গেলো  । আবহাওয়া অসহ্য লাগছিলো । অত্যধিক গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত অবস্থা । ট্রেন ছুটে চলেছে উত্তর প্রদেশের ভেতরে দিয়ে । প্রায় আড়াই লক্ষ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই প্রদেশটি ভারতের অন্যতম বৃহৎ একটি অঙ্গরাজ্য । সুতরাং কলকাতা টু দিল্লি ভ্রমণের একটা বড় সময় কাটে এই উত্তর প্রদেশের ভেতরেই ।

আমি রাজশাহীতে থেকেছি প্রায় সাড়ে তিনবছর । গরম বা শীত, উভয়ের জন্যই চরমভাবাপন্ন একটি শহর এটি । একতলা একটি মেসে থাকতাম সেখানে । সারাদিন গরমে সেদ্ধ হতাম আর দিন শেষে ছাদে গিয়ে পানি ঢালতাম । তবুও গরম যেতো না। গরমের ভাব কমতে কমতে রাত ১২ টা বেজে যেতো আবার ভোর চারটার দিকে সূর্য তেতে যেতো - অবস্থা কিছুটা এমনই ছিলো ।

কিন্তু আজকে ইউপির ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় অতীতে লব্ধ এই অভিজ্ঞতা নিছকই শিশু মনে হচ্ছিলো । ভয়াবহ গরম এক কথায় । চলমান ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে হাত দিলে মনে হচ্ছিলো হাত সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে । গরমে যাত্রী সকলের প্রাণ ওষ্ঠাগত । এই গরমেরও একটা পজিটিভ দিক ছিলো । মনে হচ্ছিলো ইউপিতে যতই গরম হোক না কেনো, হিউমিডিটি একদম নেই বললেই চলে । গরমে সিদ্ধ হচ্ছি ঠিকই, কিন্তু শরীরে এক বিন্দুও ঘাম নেই। এই জিনিস টা ভালো লেগেছে । যাহোক, তবুও সূর্যের অস্তিত্ব আর সহ্য হচ্ছিলো না । সুফলকে ডাক দিয়ে সরাসরি বলেই দিলাম - দেখ মামা আর যেখানেই যাই বা না, অন্তত রাজস্থান যাচ্ছি না এই সময়ে । এখানেই গরমে কুলাতে পারছি না , রাজস্থানে গেলে নিশ্চিত অসুস্থ হয়ে যাবো । গুগলে সার্চ দিয়ে দেখলাম তখন রাজস্থানের তাপমাত্রা প্রায় ৪৫-৫০ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড । এসব দেখেই বাইপাস প্লান থেকে রাজস্থান ক্যান্সেল করলাম ।

 

দিল্লিতে পৌঁছানোঃ

নির্ধারিত সময়ের চেয়ে এক ঘণ্টা বিলম্বে রাত ৯ টা ৪৫ এ গিয়ে আমরা পৌঁছলাম নিউ দিল্লি রেলওয়ে স্টেশনে । এখানে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করার সময় নেই । এখন গন্তব্য কাশ্মীর গেট । কারণ সেখানে থেকেই জম্মুগামী সকল বাস ছেড়ে যায় । সন্ধ্যা ৭ টা থেকে রাত ১০ অবধি এই বাসগুলো পাওয়া যায় । দিল্লি টু জম্মু প্রায় ৫৭৬ কিলোমিটার রাস্তা, যেতে সময় লাগে প্রায় ১০ ঘণ্টা। বাস ভাড়া কমবেশি ৫০০ থেকে শুরু । সেই হিসেবে আমরা দ্রুত ট্রেন থেকে নেমেই অটো নিয়ে চলে গেলাম কাশ্মীর গেটের কাছে । গিয়ে আমাদের বাজেটের বাস পেলাম না । আছে সব ভলবো বাস । ভাড়া জনপ্রতি চায় ১২০০-১৩০০ রুপি।

পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে, দিল্লি থেকে জম্মুর সব বাজেটের বাসই আছে । আমরা হয় লেট করে ফেলেছি নাহলে সিস্টেম লস করে ফেলেছিলাম, তাই নরমাল বাস পাইনি । আপনারা এই রুটে নরমাল বাসে যেতে চাইলে আগে থেকেই খোঁজ নিয়ে সময়মতো চলে যাবেন । আশা করি সমস্যা হবে না।

যাহোক, এতো টাকা দিয়ে তো আমরা দিল্লি থেকে জম্মু যাবো না। আজকে যেভাবেই হোক জম্মু যেতেই হবে, নাহলে দিল্লিতে থাকতে হবে । এতে করে একটা দিন লস সহ খরচ বেড়ে যাবে অনেক । সোয়া দশটার মতো বাজে । ভলবো টাও ছেড়ে যাবে সাড়ে দশটার দিকে ।ভালোই মুসিবতে পড়ে গেলাম ।  হাতে কোন অপশনই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ভলবো কাউন্টারে গিয়ে আমাদের সমস্যার কথা খুলে বললাম । ওনারা সমাধান দিলেন । এজন্য আজকেও তাদেরকে ধন্যবাদ দিচ্ছি ।

তাদের দেয়া সমাধান অনুযায়ী সেখানে থেকে সেই একই অটোতে চেপে দ্রুত চলে গেলাম ওল্ড দিল্লি রেলওয়ে স্টেশনে । উদ্দেশ্য আজমীর থেকে ছেড়ে আসা জম্মুগামী জম্মু-তাওয়াই(১২৪১৩) এক্সপ্রেস ধরা যেটা কিনা ওল্ড দিল্লি থেকে ছেড়ে যাবে সাড়ে দশটায় । ওদের এতো বিশাল বিশাল রেলস্টেশন সব, আগামাথা বুঝে উঠতেই কিছু সময় চলে যায় । কিন্তু সেই কিছু সময় খরচ করার মতো অবস্থা তখন ছিলো না । একজায়গায় কাউন্টার দেখে দুই বন্ধু দুই আলাদা সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে গেলাম । বলা তো যায় না যদি কোন সিরিয়ালে জম্মুর টিকিট না দেয়, তাই সিকিউরিটির জন্য দুইজনই লাইনে দাঁড়ালাম । আমাদের ধারণা টা কাজে দিয়েছে । সুফলের সিরিয়ালে টিকিট দেয়নি, দিলো আমার সিরিয়ালে । টিকিট হাতে পেয়েই প্ল্যাটফর্ম নম্বর ৮ এর দিকে দৌঁড় । হাওড়া, ওল্ড দিল্লি, নিউ দিল্লি এতো বড় বড় রেলস্টেশন সব, মাথা খারাপ হয়ে যায় নিজেদের প্ল্যাটফর্ম খুঁজে পেতে । এরকম অভিজ্ঞতা অনেক হয়েছে । যাহোক, গিয়ে নিজেদের ট্রেনে উঠে পড়লাম।

আমি যখন আজকে ১৫ মাস পরে ঘরে বসে এই কথাগুলো লিখছি, ঠিক সেদিনের সেই সময় টা ফিল করতে পারছি , এখানে বসেই মনে হচ্ছে আমার অনেক তাড়া, মুভ ফাস্ট । এখনি টিকিটের ব্যাপারে পাঠককে বিস্তারিত বলতে গিয়ে ট্রেন ফেল করবি ব্যাটা । আগে ট্রেনে ওঠ । ট্রেনে ওঠার পরে কিছুটা রিলাক্স হলাম । এখন বলছি । এই টিকিট টা ছিলো মূলত জেনারেল কোটায় । এই দীর্ঘ ৫৭৬ কিলোমিটার যেতে সময় লেগেছে ১০ ঘন্টা, খরচ হয়েছে জনপ্রতি ১৮৫ রুপী । আমি জানি না, ভারতীয় রেলের জেনারেল টিকিটে ভ্রমণের ব্যাপারে আপনাদের জানাশোনা কতটা । আমি নিজেও এই প্রথম জেনারেলে ভ্রমণ করলাম । অভিজ্ঞতা হলো বেশ ।

আপনারা জানেন নিশ্চয়ই, ভারতীয় নাগরিকদের অনেক দূরের গন্তব্যে যেতে হলে এক বা দুই মাস আগে থেকেই টিকিট কাটতে হয় । তাছাড়া উপায় থাকে না । সেক্ষেত্রে কেউ টিকিট না পেলে এবং ভ্রমণ টা অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ হলে বা অতিশয় দরিদ্র হলে তাদের জন্য এই জেনারেল সিস্টেম । প্রতিটি ট্রেনেই একটি বগি বরাদ্দ থাকে জেনারেলে ভ্রমণেচ্ছুকদের জন্য । সবশেষে বলে রাখা ভালো, It might be a hectic experience to travel with general ticket for a long journey. অভিজ্ঞতার জন্য হলেও একবার অবশ্যই ভ্রমণ করার পরামর্শ দেবো আমি । নিঃসন্দেহে একজন মাইণ্ডফুল ট্রাভেলারের ভ্রমণবিষয়ক সকল অভিজ্ঞতা থাকা চাই ।

 

জম্মু-তাওয়াই তে চড়ে জম্মুর পানেঃ

এতো তাড়াহুড়া করে ট্রেনে উঠলাম, কিন্তু সেই ট্রেন আর মুভ করে না। এ কেমন কথা । দুই বন্ধু মিলে উঠে গেলাম আমাদের বগিতে । আরো বিশ মিনিট পরে ট্রেন ছাড়লো জম্মুর উদ্দেশ্যে । শুরু হলো আমাদের জেনারেল এক্সপেরিয়েন্স । কই বসি, কই দাঁড়াই কোন ঠিক ঠিকানা নেই । জেনারেলের সকল যাত্রী দেখি একই জায়গায় জড়াজড়ি করে পরে আছে । রাত গভীর হলে দুই বন্ধু এক চিপায় শুয়ে পড়লাম । ভালো ঘুম হলো না, বাট চেষ্টা করলাম ঘুমাতে । সকাল হতেই বগি কিছুটা ফাঁকা হয়ে গেলো । গিয়ে একটা সিটে বসে পড়লাম । আশেপাশের দৃশ্যগুলো তেমন একটা ভালোলাগছিলো না । গতদিন ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়াও হয়নি । ট্রেন থেকে কিছু হাবিজাবি খেয়েছিলাম শুধু । যাহোক, পরদিন ৩১/০৫/১৯ তারিখ সকাল প্রায় সাড়ে আটটার দিকে ট্রেন গিয়ে জম্মুতে পৌঁছালো । আমরাও আমাদের ভ্রমণ শেষ করে নেমে পড়লাম ।  বিশ্রাম নেয়ার বা নষ্ট করার মতো কোন সময় আমাদের হাতে তখনো ছিলো না । এখন আবার ছুটতে হবে শ্রীনগরের দিকে ।

 

আজকের খরচ(৩০-০৫-১৯)

 

১। খাওয়া = ১০৫ রুপী

 

২। নিউ দিল্লি-কাশ্মীর গেট-ওল্ড দিল্লি রেলস্টেশন (অটো) = ৬০/-

 

৩। দিল্লি-জম্মু(ট্রেন) = ৩৭০/-

 

মোটঃ ৫৩৫ রুপী

 

 

র‌্যুট-ঢাকা>কলকাতা>দিল্লি>জম্মু>শ্রীনগর>কার্গিল>লেহ>প্যাংগং>লেহ>মানালি>দিল্লি>কলকাতা>ঢাকা

 

(চলবে...)

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন