এমদাদুল ইসলাম
ছোটবেলায় দেখেছি আমাদের বাসার দেয়ালে একটা সুন্দর জলপ্রপাতের ছবি টানানো ছিল। বড় হয়ে জেনেছি ছবিটি ছিল সুইজারল্যান্ডের রাইন ফলস। ছবিটি দেখে সেই কিশোর বেলায় খুব ইচ্ছা হতো, যদি কখনো সুইজারল্যান্ড যেতে পারতাম। উপরওয়ালা হয়তো তখনই আমার জন্য এই ভ্রমণটা ঠিক করে রেখেছিলেন। জার্মানিতে আসার পর থেকে রাইনফলস দেখার জন্য উদগ্রীব ছিলাম। জার্মানিতে এসেছি কয়েক মাস হল। এখানকার পথঘাটই ঠিক মতো চিনি না। তারপরও আশায় বুক বেঁধে চেনাজানা লোকদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে রাইনফলস ভ্রমণের পরিকল্পনা করে ফেললাম। জার্মানিতে ইউরোপ ভ্রমণের জন্য কিছু গ্রুপ টিকেট পাওয়া যায়। আমরাও পাঁচ জনের একটা গ্রুপ টিকেট নিলাম। খরচ পড়ল ৪৮ ইউরো। আমি যে শহরে থাকি সেখান থেকে সুইজারল্যান্ড যাওয়ার প্রায় এক তৃতীয়াংশ পথ আমার ইউনিভার্সিটির সেমিস্টার টিকেট কভার করে। তাই যে স্টেশনে আমার ফ্রি রেল টিকেট শেষ হয়েছে ওখান থেকে আমাদের গ্রুপ টিকেট কেটেছিলাম।
সুইজারল্যান্ড যাওয়ার পথে মুফতে উপভোগ করেছিলাম জার্মানির সৌন্দর্য। ফ্রান্সের বর্ডার ঘেঁষে রেললাইন। পাহাড় কেটে বসানো রেল ট্র্যাক। পথে পথে সাদা মেঘগুলো আটকে আছে পাহাড়ের গায়ে। মেঘের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিল আমাদের ট্রেন। কল্পনাতেও এতটা সুন্দর একটা দৃশ্য ভাবা যায় না। আমরা যখন সুইজারল্যান্ড সাফহাউজেন পৌঁছায় তখন ১১ টা ৩০ বাজে। ওখান থেকে আরেকটা ট্রেন করে রাইনফলস। পাঁচ ঘন্টার ভ্রমণ শেষে যখন রাইন ফলস দেখেছি, সব ক্লান্তি উধাও। অবচেতন মনে বলে উঠলাম, মাশাআল্লাহ প্রকৃতি এত সুন্দর হতে পারে! আমরা জলপ্রপাতের মূল এলাকায় ঢোকার আগে দুপুরের খাবার সেরে নিয়েছিলাম। খাবার দাবার সব সাথে করেই নিয়েছিলাম। কারণ ইউরোপের যেকোন ট্যুরিস্ট স্পটে খাবারের দাম অনেক বেশি থাকে। এত সুন্দর একটা যায়গা কিন্তু প্রবেশের জন্য কোন টাকা লাগে না। হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু নেই কোন কোলাহল কিংবা ময়লা আবর্জনা। মজার ব্যাপার হলো তারা যে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যপারে খুব যে কঠোর তাও না। তবে মানুষের মানসিকতা পরিষ্কারের জন্য বড় হাতিয়ার। এই জলপ্রপাতের সব চেয়ে বড় সুবিধা হলো, এটাকে খুব কাছে থেকে দেখার যত রকম সুবিধা দেয়া যায় তা সেখানে আছে।
আপনি চাইলে নৌকা নিয়ে খুব কাছে গিয়ে জলপ্রপাতের জল পড়ার ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে পারেন। এর জন্য নৌকা ভাড়া ৬.১ ইউরো। তবে বুকে সাহস না থাকলে এটা করার দরকার নেই। যতই এর কাছে যাচ্ছিলাম, মুগ্ধ হচ্ছিলাম। এতটা সুন্দর কল্পনাও করা যায় না। যদিও আমার মোবাইলের ক্যামেরা অতটা ভালো না, তবুও চেষ্টা করছিলাম এই সৌন্দর্য্যটুকু মোবাইলে ধরে রাখতে। সৌন্দর্য্য আসলে এমন একটা জিনিস, যেটাকে সবসময় বর্ণনা করা যায় না। রাইন ফলসের ক্ষেত্রেও ঠিক এই উক্তি মিলে যায়। এটা না দেখলে আসলে বুঝার কোন উপায় নেই।
রাইন ফলস নদীর ওপর একটা রেল সেতু আছে। সেতুটি পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত। এই সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে রাইনফলসের অপার্থিব সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায়। সেতুর উপর রেললাইনের দু পাশে তারের বেড়া। বেড়ার মধ্যে অনেকগুলো তালা মারা। তালাগুলোতে প্রেমিক-প্রেমিকাদের নাম লেখা। এটাকে বলে লাভ লক। প্রেম যেন চিরস্থায়ী হয় সেজন্যই এভাবে তালা দেয়া। চাইলে আপনিও আপনার কাছের মানুষ নিয়ে রাইন ফলসের উপর লাভ লক করে আসতে পারেন।
ফলসের পাশেই রাজ প্রাসাদ। এটার ভিতরে ঢুকতে টাকা লাগে। তাই এটাকে ভ্রমণ পরিকল্পনা থেকে থেকে বাদ দিয়েছিলাম। কিন্তু প্রাসাদের বাইরের দৃশ্যটা দেখার মত। সব কিছু দেখা শেষ করে মুগ্ধতার আবেশ গায়ে মেয়ে আমরা বিকাল সাড়ে পাঁচটার ট্রেনে সাফহাউজেন ফিরে যাই। আমাদের একদিনের ট্যুরে সব মিলিয়ে জনপ্রতি খরচ হয়েছে ১৬ ইউরোর মত। মানে ১৬০০ টাকা প্রায়। মাত্র ১৬০০ টাকায় এমন একটা স্বপ্নের মত দিন কাটাতে পারব, তা কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি।
লেখক: জার্মান প্রবাসী