স্বপ্নের শহর ইস্তাম্বুল

ডা. মো. মিজানুর রহমান

ইস্তাম্বুলকে আমার অধিক চেনা মসজিদের শহর হিসেবে। তখনও তুরস্কের নাম শুনিনি। আমার মত এখনও অনেকে আছে তুরস্ক থেকে ইস্তাম্বুলকে বেশি চিনেন। ইস্তাম্বুল তুরস্কের রাজধানী। ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ ইস্তাম্বুল পৃথিবীর বুকে একটি অনন্য শহর। কত নামেই ডাকা যায় এই শহরকে। ইউরোপের প্রবেশদ্বার, আন্তঃমহাদেশীয় শহর, ইউরোপের বৃহত্তম শহর, রোমান, বাইজেন্টাইন ও অটোমান সম্রাজ্যের রাজধানী। চতুর্দশ খ্রিস্টাব্দে অটোমন সুলতান দ্বিতীয় মেহমুদ রোমানদের পরাজিত করে কনস্টান্টিনেপলের নাম পরিবর্তন করে ইস্তাম্বুল রাখেন এবং ইসলামী খেলাফত বা অটোমান সম্রাজ্যের রাজধানী বুরসা থেকে ইস্তাম্বুলে স্থানান্তর করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আধুনিক তুরস্কের জনক মোস্তফা কামাল আতার্তুক ইস্তাম্বুল থেকে রাজধানী আঙ্কারায় স্থানান্তর করলেও এর গুরুত্ব বিন্দু পরিমাণ কমেনি। এখনও তুরস্কের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেও কেন্দ্রবিন্দু ইস্তাম্বুল। কৃষ্ণ সাগর ও মর্মর সাগরের মধ্যবর্তী এবং বসফরাস প্রণালীর দুই কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা এই শহরের প্রতিটি ইট, কাঠই এক একটি ইতিহাস। আর ইতিহাসকে জানতে, নিজের চোখ দিয়ে ইতিহাসকে পরখ করতে এবং নিজেও ইতিহাসের অংশ হতে প্রতি বছর সারা পৃথিবী থেকে কোটির উপরে পর্যটক আসে ইস্তাম্বুলে।

মুসলিম নিদর্শনে ভরপুর এই শহর পর্যটক আগমনের দিক দিয়ে পৃথিবীতে ৪র্থ।  পড়াশুনার সুবাদে আমি থাকি তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারার মিডল ইস্ট টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে। পড়াশুনার যথেষ্ট চাপ থাকা সত্ত্বেও প্রতি সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোতে কোথাও না কোথাও ঘুরতে যাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্রমণ গ্রুপের সঙ্গে। ইস্তাম্বুলের পালা আসতেই চোখের ঘুম উধাও। সময় যেন আর কাটেনা। প্রথমবারের মত ইউরোপে যাবার হাতছানি। আঙ্কারায় থাকলেও মন পড়ে আছে স্বপ্নের শহর ইস্তাম্বুলে। মনে হচ্ছে সপ্তাশ্চর্য হাজিয়া সোফিয়া, সুলতান সুলেমানের প্রাসাদ তপকেপি প্যালেস, বন্টু মস্ক ও বসফরাস প্রণালী যেন আমায় প্রতিনিয়ত ডাকছে। অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। রাত ৩ টায় রিজার্ভ বাসে রওনা দিয়ে সকালে মর্মর সাগরের সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে বসফরাস প্রণালী পার হয়ে ইস্তাম্বুলের ইউরোপিয়ান অংশের সুলতান আহমেদ স্কয়ারের পাশে একটি হোটেলে উঠলাম। ব্যাগ রেখে গেলাম ইস্তাম্বুলের সবচেয়ে দর্শনীয় স্থান হাজিয়া সোফিয়া, বসফরাস প্রণালীর পাশে সুলতান সুলেমান তথা অটোমান সম্রাটদের প্রাসাদ তপকেপি প্যালেস এবং তুরস্কের অন্যতম আকর্ষণ ও ইসলামী ইতিহ্যের নিদর্শন সুলতান আহমেদ মসজিদ বা বন্টু মস্ক দেখতে। সারাদিন অসম্ভব সুন্দর এই স্থানগুলোতে ভ্রমণ শেষ করে রাতে হোটেলে ফিরলাম।

বসফরাস প্রাণালীর উভয় পাশে সুন্দর সাজানো শহর ইস্তাম্বুল 

পরদিন সকালে গেলাম বসফরাস প্রণালীতে ক্রুজ ট্যুরে। সে এক অসাধারণ দৃশ্য। গোল্ডেন হর্ন থেকে আমাদের জাহাজ ছুটে চলেছে বসফরাসেরর নীল পানির বুক চিরে। উপরে নীল আকাশে সাদা গাংচিলের খেলা, সঙ্গে দু পাশের মনরোম দৃশ্য। একদিকে ইউরোপ, অন্যদিকে এশিয়া। এক সঙ্গে দুটো মহাদেশ দেখার বিরল অভিজ্ঞতা শুধু এখানেই সম্ভব। বসফরাস ভ্রমণ শেষে মাছ দিয়ে পাউরুটি খেয়ে কিছু কেনাকাটা কওে শেষ করলাম সেদিনের মত ইস্তাম্বুল দর্শন। শহর বা নগর আমাকে টানে না, যেভাবে টানে পাহাড় ও প্রকৃতি। কিন্তু ইস্তাম্বুলের ক্ষেত্রে পুরোই উল্টো। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পাশাপাশি সৌন্দার্য্যরে দিক দিয়েও অসাধারণ এই শহর। এখানকার মানুষগুলো যেমন দেখতে সুন্দর, তেমন সুন্দর রাস্তাঘাট ও তাদের ঘরবাড়ি। তুরস্কের সবকিছুই গোছানো ও পরিকল্পিত। অসংখ্য ও বিশাল বিশাল চওড়া রাস্তাগুলির দু ধারের সুন্দর সুন্দর ইমারতগুলো দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। এছাড়া ট্রাম,মেট্রোতো আছেই।

তাই এত জনবহুল শহর হওয়া সত্ত্বেও যানজট নেই বললেই চলে। তুর্কিরা জাতিগতভাবে যোদ্ধা হলেও আচার-আচরণে অনেক বিনয়ী। পুরো তুরস্ক ঘুরেও আমার কখনও নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা হয়নি। বাংলাদেশকে সবাই চেনে না। তবে রোহিঙ্গা সমস্যার কারণে এখন অনেকেই বাংলাদেশ সম্পর্কে জানে। প্রায় শতভাগ মুসলমানের এই দেশে যারা চেনে, তারা বাংলাদেশকে বেশ ভালবাসে। এমনও হয়েছে দোকানে চা খাওয়ার পরে মুসলিম জানার পরে বিলতো নেইনি উপরন্তু টি ব্যাগ উপহার দিয়েছে। ভারতের কাশ্মীরেও বাংলাদেশি ও মুসলিম হওয়ার কারণে ভাল আতিথেয়তা পেয়েছিলাম।

ইস্তাম্বুলের সবকিছু ভাল লাগলেও দুটি ব্যাপার আমাকে খুব পীড়া দিয়েছে। এক, এখানকার লোকের ইংরেজি জ্ঞান। ইয়েস নো ভেরি গুড টাইপের ইংরেজিও জানে না। দুই, ভাত পাওয়া যায় না। আমার মতো ভেঁতো বাঙালির তাই অনেক কষ্টও হয়েছে। তুর্কিরা ভাতের পরিবর্তে পাউরুটি খায়। আবার সেগুলো লোহার মত শক্ত। তবে এখানে গমের ভাত খাওয়ার এক বিরল অভিজ্ঞতা হয়েছে। এরপর একে একে ডলমাবেচ প্যালেস, গালাটা টাওয়ার, ঐতিহাসিক তাকসিম স্কয়ার ও তাকসিন স্কয়ারে অবস্থিত মাদাম তুসোর মিউজিয়াম, ক্যাবল কার, বেয়ারলিবে প্যালেস, মিসরীয় মসলার বাজার, গ্রান্ড বাজার, আ্যাকুরিয়ামে ডলফিন ও সিল মাছের অসাধারণ কলা কৌশল দেখে শেষ করলাম স্বপ্নের ইস্তাম্বুল দর্শন।

অতি প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য

১. ইস্তাম্বুল ঘুরে দেখতে কমপক্ষে দু সপ্তাহ সময় নিবেন।

২. ইস্তানবুল ও তুরস্কে অসংখ্য মিউজিয়াম আছে। প্রতিটি জায়গায় টিকেট কাটা থেকে একটা মিউজিয়াম কার্ড, যার মেয়াদ ১ বছর কিনে নিলে সাশ্রয় হবে।

৩. ইস্তাম্বুলে ঘুওে বেড়াবার জন্য ইস্তাম্বুল কার্ড নিলে ঘোরাঘুরি সহজ ও সাশ্রয় হবে।

৪. সুলতান আহমেদ স্কয়ার থেকে big bus  নামে সিটি ট্যুরের গাড়ি করে ইস্তাম্বুলের দর্শনীয় স্থানসমূহ ঘুরে দেখা সহজ হবে।

৫. তুরস্কে যেতে ভিসার জন্য বাংলাদেশে অবস্থিত টার্কিশ অ্যাম্বাসিতে যোগাযোগ করতে হবে। তুরস্ক দূতাবাসের ঠিকানাঃ বাড়ি নং-৭, রোড নং-২, বারিধারা, ঢাকা-১২১২ ফোন: ৮৮২২১৯৮, ৮৮১৩২৯৭, ৮৮২৩৫৩৬ ওয়েবসাইট- www.dakka.be.mfa.gov.tr

ভিসার আবেদনের ক্ষেত্রে আপনার পাসপোর্টে যদি পেশা সরকারী চাকুরীজীবি লেখা থাকে তাহলে সেক্ষেত্রে আপনাকে এন,ও,সি করিয়ে রাখতেই হবে। এনওসি মানে নো অবজেকশন সার্টিফিকেট। আর  ছাত্র হলে ছাত্রত্ব সনদ বা জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে বাকী কাগজ হালনাগাদ করতে হবে। তুরস্কে সাধারণ মানের হোটেল প্রতিজনের জন্য দুই থেকে চার হাজার টাকার মধ্যে পাবেন। বাংলাদেশ থেকে তুরস্কগামী বেশ কিছু ফ্লাইট আছে যার মধ্যে টার্কিশ এয়ারলাইনস অন্যতম। এছাড়া আছে, ইতিহাদ, এমিরেটস, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস, জেট এয়ারওয়েজ, মালিন্দ এয়ার, এয়ার ইন্ডিয়া ইত্যাদি। বিমান খরচ আপনি কবে, কখন, কোন ক্যারিয়ারে যাচ্ছেন, তার ওপর প্রধানত নির্ভর করে থাকে। এখানে ভালো মানের হোটেল ও ট্রান্সপোর্টেশনের জন্য বেশ টাকাপয়সা খরচ করতে হবে আপনাকে, তাই যেসব যায়গায় মোটামুটি হাটা দুরত্বে ঘুরতে পারবেন, সেখানে গাড়ি না নেওয়াই ভালো।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন