স্বচ্ছ জলের গ্রাম ‘সোনাংপেডেং’

আরিফুল রাজিব

অমাবস্যার রাতে আকাশে লক্ষ তারা দেখতে দেখতে কিংবা গৃহত্যাগী জ্যোৎস্নাময় রাতে পাহাড়ি নদীর ধারে তাবু খাঁটিয়ে বাস করতে চান? আর যদি এর সঙ্গে ক্যাম্প ফায়ার অথবা স্বচ্ছ জলের বহমান পাথুরে নদীতে ঝাপাঝাপি কিংবা নৌকায় চড়ে ঘুরতে চান? যাদের আগ্রহ আছে তাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে সোনাংপেডেং। বড় কোন ছুটির দরকার নেই, মাত্র দুই দিন সময় হাতে নিয়েই ঘুরে আসতে পারেন বাংলাদেশের খুউব কাছে মেঘালয়ের স্বচ্ছ জলের গ্রাম থেকে।

সোনাংপেডেং ভারতের মেঘালয় রাজ্যের জৈন্তা হিলস জেলার অর্ন্তগত একটি অপরূপ পাহাড়ি গ্রাম। দূরত্ব বাংলাদেশের তামাবিল বর্ডার থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার। সোনাংপেডেং এর সৌন্দর্য্যরে প্রধান আকর্ষণ গ্রামেরর ভিতর দিয়ে বয়ে চলা স্বচ্ছ, সবুজ জলের পাথুরে নদী উমংগট। এই নদীটিই জাফলং সীমান্ত দিয়ে গোয়াইন নদী নামে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। উল্লেখ্য, এই নদীর বাংলাদেশে প্রবেশ মুখেই সিলেটের বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র জাফলং অবস্থিত।

যেভাবে পৌঁছাই স্বচ্ছ জলের গ্রামে

ভোর ৫ টায় শুরু হয় যাত্রা। প্রথমে সিলেটের কদমতলী বাসস্ট্যান্ড। সেখানে বাস যাত্রা আর তারপর বাস থেকে নেমে নাস্তা সেরে সকাল ৯টার মধ্যে তামাবিল স্থলবন্দর। বন্দরে ভিড় নেই। তবে ট্রাভেল ট্যাক্স দিতে গিয়ে ঘটলো বিপত্তি। কারণ বন্দরে এখন আর ট্রাভেল ট্যাক্স দেয়া যায় না। ট্রাভেল ট্যাক্স জমা দিতে হবে জৈন্তাপুরে। অগত্যা জৈন্তাপুর ফিরতে হল। ট্রাভেল ট্যাক্স জমা দিয়ে আবার বন্দরে ফেরত আসতে আসতে সকাল ১০.৩০ মিনিট। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ইমিগ্রেশন শেষ করে ভারতে প্রবেশ করলাম। ভারতীয় ইমিগ্রেশন শেষ করে ইমিগ্রেশন ভবনের সামনে জিপ স্ট্যান্ড হতে চার আসনের গাড়ি রিজার্ভ করে ফেলি। আমাদের প্রথম গন্তব্য ক্রাংসুরি ঝর্ণা। গাড়ি আমাদের ডাউকি বাজার হয়ে ক্রাংসুরি ফলস ঘুরিয়ে সন্ধায় সোনাংপেডেং এ নামিয়ে দেবে। ভাড়া ঠিক হল ২ হাজার রুপি। ডাউকি বাজার থেকে আমরা মোবাইল সিম ও রুপি সংগ্রহ করে রওনা হলাম ক্রাংসুরির উদ্দেশ্যে। যদিও আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য সোনাংপেডেং। তবে ক্রাংসুরি দেখাটা আমাদের ভ্রমণের বাড়তি পাওনা।

প্রতিবার সিলেট ঘুরতে এসে মেঘালয় পাহাড়গুলো ছুঁতে না পারায় মনে কষ্ট হতো। তবে আজ গাড়ি ছুটে চলছে মেঘালয় পাহারের উপর দিয়ে। মাঝে মাঝে গাড়ির জানালা দিয়ে পাহাড়ের নিচে চোখে পরছে আমার প্রিয় বাংলাদেশ। ডাউকি টু ক্রাংসুরি যাওয়ার রাস্তায় সৌন্দর্য্য দেখে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ছবি তোলার ইচ্ছাটা অনেক কষ্টে দমন করতে হয়েছিল। 

ডাউকি টু ক্রাংসুরি যাওয়ার রাস্তা

ঘন্টাখানেকের মধ্যে আমরা চলে আসি ক্রাংসুরি। গাড়ি থেকে নেমে প্রথমেই ঢুকে পড়ি রেষ্টুরেন্টে। কারণ, এখনও দুপুরের খাবার খাওয়া হয়নি। প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত। তাই আগে চাই উদর পূর্তি। খাওয়া শেষ করে পাহাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে শুরু করলাম। কিছু সময় নামার পর দৃশ্যমান হলো ক্রাংসুরি। ক্রাংসুরির উপরিভাগটা দেখতে অনেকটা নদীর মতো। যার সামনে একটি বাঁধ দেয়া আছে। আর সেই বাঁধ থেকেই পানি উপচে পড়ছে। টিকিট কাউন্টার থেকে জন প্রতি ৫০ রুপি করে টিকিট সংগ্রহ করে ক্রাংসুরির মূল এলাকায় প্রবেশ করলাম।  ভরা বর্ষায় ঝর্ণা যে যৌবনাবতী হয় এখন তা নেই। পানির পরিমাণ খুব কম হলেও এক অদ্ভুত সৌন্দর্য্য নিয়ে বসে আছে ক্রাংসুরি। কাচের মতো স্বচ্ছ পানি, উপর থেকে মনে হচ্ছিলো গাড় নীল। পানির এমন স্বচ্ছ ও নীল রং এর আগে কখনো দেখিনি। পানিতে ঝাঁপ দেয়ার চিন্তাটা মাথাথেকে ঝেড়ে ফেলতে হলো পানিতে পা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে। ভয়ঙ্কর রকমের ঠাণ্ডা। একমাত্র আকিব ভাই পানিতে নামার সাহস দেখান। যদিও পানি থেকে উঠার পর যা ঘটেছিল তা ইতিহাস। ঝর্ণার পানিতে নামতে হলে ৩০ রুপি দিয়ে লাইফ জ্যাকেট ভাড়া করতে হয়। লাইফ জ্যাকেট ছাড়া কাউকে পানিতে নামতে দেওয়া হয় না। আপনি চাইলে ঝর্ণার উপরিভাগে বাঁধের ওপাশে নীল জলে লাল রঙের নৌকায় চড়তে পারবেন। তবে আমরা ঝর্ণায় সৌন্দর্য্য দেখে এতটাই বিমোহিত হয়েছিলাম যে ঐ দিকে যাওয়ার ইচ্ছেই হয়নি। 

ক্রাংসুরি

ক্রাংসুরি থেকে রওনা হয়ে আমরা সন্ধ্যায় সোনাংপেডেং পৌঁছালাম। ঢোকার সময় সোনাংপেডেং ডিফেন্স পার্টির কাছ থেকে ৩০ রুপি দিয়ে প্রতি গাড়ির প্রবেশ টিকেট নিতে হলো। এবার আমাদের ভ্রমণের মূল আকর্ষণ সোনাংপেডেং এর উমংগট নদীর তীরে তাবুতে থাকার পালা। দ্রুত তাবু ভাড়া করে ফেললাম। দুই জনের সাইজের তাবু ভাড়া ৭০০ রুপি এবং ৩ জনের সাইজের তাবু ১০০০ রুপি। আপনারা চাইলে কটেজেও থাকতে পারেন। তবে সোনাংপেডেং এ তাবুতে থাকই উত্তম। তাবু আমাদের টানাতে হয়নি, যাদের কাছ থেকে ভাড়া করেছিলাম তারাই টানিয়ে দিয়েছিল। হোটেলে রাতের খবারের অর্ডার দিয়ে দিলাম। খাবার তাবুতে পাঠিয়ে দেবে। আপনারা চাইলে হোটেলে গিয়েও খেয়ে আসাতে পারেন।

নদীর পাশে বালুর উপর আমাদের তাবু ফেলা হয়েছে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাস, তাবুর সামনে পাথরের উপর বসলাম, আকাশে চাঁদ, লক্ষ লক্ষ তারা জ্বলজ্বল করছিল। সামনে নদীর ওপারে বিশালাকার সুউচ্চ পাহাড়টা আধারে মনে হচ্ছিল বড় পর্দার মতো। আমাদের তাবুর আশেপাশে অনেকগুলো তাবু। বেশকিছু তাবুর সামনে আগুন জ¦লছিল। হঠাৎ করেই আকিবুল ভাই দরাজ গলায় গাইলেন, বেঁধেছে এমনও ঘর শূন্যের উপর পোস্তা করে..... ধন্য ধন্য ও বলি তারে.....। রাতের আঁধার নদীর জলের স্বচ্ছতাকে গ্রাস করে নিলেও ক্যাম্প ফায়ারের আলো আর পাথুরে নদীর জল-পাথরের সঙ্গে সংগীত মিলে তৈরি করছিল এক অদ্ভুত মাদকতা।

গানের আসর

কখন ঘুমিয়ে গেছি টের পায়নি। যখন ঘুম ভাঙলো তখন সময় সকাল ৭টা। বাইরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাস। তাবু থেকে বের হলাম। ক্যাম্প জোনের পাশেই রয়েছে পর্যটকদের জন্য বাথরুম ও ফ্রেশ হওয়ার স্থান। ফ্রেশ হয়ে, নাস্তা করে প্রথমেই চলে যাই সাসপেন্স ব্রিজে। সাসপেন্স ব্রিজই সোনাংপেডেং এর সৌন্দর্য্য উপভোগ করার উত্তম স্থান। ব্রিজের উপর থেকে নিচে নদীর স্বচ্ছ জল দেখতে গাড় নীল। পানির নিচে প্রতিটি পাথর দেখা যাচ্ছিল।নৌকাগুলো যেন স্বচ্ছ কাচের উপর ভাসছে।  ক্যামেরার প্রতিটি ক্লিকে পানির রং এর ভিন্নতা ধরা পড়ছিল। নৌকাগুলো দেখে মনে হচ্ছিল যেন স্বচ্ছ কাচের উপর ভাসছে। ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডা পানি। কিন্তু স্বচ্ছ পানিতে ঝাপাঝাপি করার লোভ সামলানো সম্ভব নয়। তাই সূর্যের তাপ একটু বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ৫০ রুপি দিয়ে লাইফ জ্যাকেট ভাড়া করে নেমে পরলাম হাড় কাপানো ঠাণ্ডা পানিতে। এখানেও লাইফ জ্যাকেট নেয়া বাধ্যতামূলক। কখন যে চলে গেছে সময় চলে গেছে বুঝতেই পারিনি। এবার দেশে ফেরার পালা।

মাথার ওপর সাসপেন্স ব্রিজ নিচে স্বচ্ছ পানির জলাশয়

দুপুর ৩টা। সোনাংপেডেং কে বিদায় জানিয়ে গাড়ি রিজার্ভ করে চলে আসি ডাউকি বাজার। সোনাংপেডেং থেকে ডাউকি বাজারে লোকাল গাড়িও আছে। আপনারা চাইলে সোনাংপেডেং থেকে সরাসরি বর্ডারে স্থল বন্দর চলে যেতে পারেন। আর যদি আমাদের মতো হাল্কা কেনাকাটা করতে চান তবে চলে আসুন ডাউকি বাজার। ডাউকি খুব ছোট একটি বাজার। বেশি কিছু নেই। তাই টুকটাক কেনাকাটা করে একগাদা সুখ স্মৃতি নিয়ে মেঘালয়কে বিদায় জানিয়ে দেশের পথ ধরলাম।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন