সাপ নিয়ে বিভ্রান্তি (পর্ব-১)

ডাঃ রাজীব হোসাইন সরকার

সাপ নিয়ে মানুষের কৌতূহলের অন্ত নেই। সাপের ক্ষমতা সম্পর্কে বেশকিছু ভুল ধারণাও আছে আমাদের। আসুন জেনে নেওয়া যাক সাপ সম্পর্কে কিছু ভ্রান্ত ধারণা ও সেগুলোর সত্যতা। বীন বাজালে সিনেমায় সাপ নাচে। বাস্তবে নাচে না। সাপের কান নেই। তাই শোনার জন্য ঘনঘন জিহ্বা বের করে। কখনও সাপ আপনাকে বিনা কারণে আক্রমণ করবে না। সাপের বুকের তলায় খোলসের রঙ আলাদা। সেখানে বিশেষ স্নায়ুতন্ত্র থাকে মাটির কম্পন বোঝার জন্য। আপনি যদি শব্দ করে হাঁটেন, সে বুঝতে পারে আপনি কতদূরে আছেন, আপনি সাইজে কতবড়, কম্পন দেখেই সে বুঝতে পেরে পালিয়ে যায়।

বেলি, হাসনাহেনার গন্ধে কখনও সাপ আসে না। কেউ কেউ বেলি, হাসনাহেনা গন্ধরাজের ফুল গাছের তলায় সাপ দেখেছেন হয়তো। তবে সেটা নেহাতই কাকতালীয়। মনে রাখবেন, সাপের ঘ্রাণশক্তি খুবই দুর্বল। সে গন্ধ পায় না। বরং ফুলের সুগন্ধিতে পোকা মাকড় আকৃষ্ট হয় বেশি। পোকা খেতে ব্যাঙ আসে। ব্যাঙ খেতে মাঝে মধ্যে সাপ আসতে পারে। খাবার পর মানুষের মত সাপও ক্লান্ত হয়। মানুষ খাবারের পর যেমন আয়েশ করে ঘুমায় তেমনই সাপও বেলি-হাসনাহেনার তলায় ঘুমুতে পারে। তবে এসব গাছ যদি বাড়ির ভেতর থাকে তবে সাপ কম আসে। কারণ, সাপ মানুষের উপস্থিতি ভয় পায়। তবে বাড়ির পাশে, ঝোপঝাড়ে এমন গাছ থাকলে সাপ আসা স্বাভাবিক।

একটা সাপকে মারলে তার সঙ্গী কখনোই আপনাকে খুঁজে দংশন করতে আসবে না। সাপের স্মৃতিশক্তি খুবই দুর্বল। সাপ সিনেমার নাগ-নাগিন নয় যে সঙ্গী হারানোর প্রতিশোধ নিতে ছুটে আসবে। সাপ নিম্নজাতের প্রাণী। এদের মধ্যে প্রতিশোধ স্পৃহা বলে কিছু নাই। কিন্তু একটা সাপ মারার পর আরেকটা সাপ প্রায়ই একই স্থানে দেখা যায়, কারণ কী? কারণটা খুবই সাধারণ। মিলনের সময় তার সঙ্গী আশেপাশে থাকতেই পারে কিংবা আশেপাশে গর্ত থাকলে তার বাচ্চাকাচ্চা কিংবা আরও সাপ উঠে আসতেই পারে। সে প্রতিশোধ নিতে আসেনি বরং ভুল করে গর্ত থেকে চলে এসেছে।

ছোট সাপের বিষ নেই, কথাটা ভুল। সাপের বাচ্চাও সাপ। কেঁচোর সমান একটা কেউটের কামড়ে আমার চোখের সামনে এক রোগিকে টানা ২৪ ঘণ্টা জীবনের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। আইসিইউতে আমরা তিন ডাক্তার তার পাশে ২৪ ঘন্টা লড়েছিলাম। কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস থেকে শুরু করে একাধিকবার অ্যান্টি-ভেনম দিয়েছি। সে সুস্থ হয়ে বাড়িতে গেছে।

রাতে যারা বাজার থেকে অন্ধকারে ঘরে ফেরে তাদের এবং জেলেদের সাপ বেশি কাটে। জেলেরা বর্ষায় রাতে আইলে, নদীর কিনারে হেঁটে হেঁটে বড়শি ফেলে, জাল ফেলে মাছ ধরে। নদী বা নালায় রাতে জাল পেতে দাঁড়িয়ে থাকে। সাপ আইল, নদীর কিনারা, পাড়কে শুকনো ভেবে সেখানে আশ্রয় নেয়। ফলে পায়ের নিচে পড়লে কিংবা সাপ নিজে ভয় পেলে কামড় দেয়।

গরুর দুধ খেতে সাপ গোয়াল ঘরে হানা দেয়। ধারণাটি একেবারেই ভুল। সাপ ক্ষেতের ব্যাঙ- পোকামাকড় খায়। বিশেষ করে কালো রঙের দাড়াশ সাপ আমাদের উপকার করে। ফসল বাঁচায়। এদের না মারা উত্তম।  

সাপে কাটলে ব্লেড দিয়ে কেটে দিলে বিষ বের হয়ে যায়, কথাটা ভুল। ভুলেও এই কাজ করবেন না। বেøড দিয়ে কাটলেন তো বিষকে রক্তের সাথে নিজহাতে মিশিয়ে দিলেন।

দংশন করা সাপকে উল্টো কামড় দিলে বিষ ফেরত চলে যায় সাপের ভেতরে। এ কথাটাও ভুল। পায়ে কাটলে বিষ সেখানে। আপনার মুখের দাঁতে তো বিষ নেই। কীভাবে ফেরত দিবেন?

 সাপের বিষ তার দাঁতে থাকে না। সে যখন কামড় দেয় তার মুখের পেশিগুলো টানটান হয়ে যায়। দাঁতের কাছেই থাকে বিষধর সাপের বিষথলী। সেখান থেকে বিষ দাঁত বেয়ে আপনার শরীরে প্রবেশ করে। 

শক্ত করে বাঁধলে বিষ ছড়াতে পারে না এমন ধারণা ভুলে যান। আপনি নিজেও নিশ্চিত না সাপটা বিষধর ছিল কি না, তাহলে শক্ত করে বাঁধবেন কেন? অনেক ডাক্তার সাপে কাটার পর বাঁধতে নিষেধও করেন। কারণ এতে হিতে বিপরীত হয়। ফুটবলের অ্যাংলেট পায়ে দিলে যেমন আটসাঁট হয়ে থাকে এমন ভাবে গামছা বা শার্ট বা শাড়ি দিয়ে দংশনের কিছু উপরে  পেঁচিয়ে নিতে পারেন। বাঁধন অবশ্যই ঢিলা রাখবেন। দুটো আঙুল ঢুকে এমনভাবে ঢিলা করবেন। আবার খুব ঢিলাও না। ২০ মিনিট পরপর খুলে আবার লাগাতে পারেন। ভুলেও লোহার তার, সুতলি, বিদ্যুতের তার বা অন্য সরু জিনিস দিয়ে বাঁধবেন না। বাঁধলে রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে হাতে-পায়ে পচন শুরু হবে। চিরতরে হাত বা পা খোয়ানোর সম্ভাবনা প্রবল। হয়তো আপনাকে বিষধর সাপ কাটেই নি অথচ আপনি ভয়ে গিট দিয়ে হাত পা পঁচিয়ে পঙ্গু হয়ে গেলেন। কেমন হবে?

Caption

সাপ কাটলে কিন্তু আংটি, চুড়ি, ব্রেসলেট খুলে ফেলবেন। কিছু সাপের বিষে আপনার আঙুল, হাত বা পা ফুলে যেতে পারে। আংটি বা চুড়ি থাকলে রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে পচন ঘটতে পারে।

 লেখক: চিকিৎসক, রংপুর মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন