কাফি কামাল
সূর্যের আলো ফোটেনি। আলো-অন্ধকারের আবছায়া ভোর। ঘুম ভাঙা চোখ মেলে দেখি যাত্রীরা সবাই ব্যস্ত অবতরণের আয়োজনে। পার্শ্বযাত্রী তরুণটিও নেই। নিশ্চয়ই তার গন্তব্যে নেমে গেছে। হয়তো বিরক্ত হবো ভেবে ঘুম ভাঙিয়ে বিদায় বলেনি। যাত্রীদের কথাবার্তায় বুঝতে পারলাম, গন্তব্য পৌঁছে গেছি। তারপরও নিশ্চিত হতে এক যাত্রীকে প্রশ্ন করলাম- এটা কোন স্টেশন? উত্তর মিলল- বাগান শোয়ে পাই টার্মিনাল। এক নির্জন নিরিবিলি বাসস্টান্ডে। হাক ডাক, চিৎকার চেঁচামেচি নেই। লোকজন নেই বললেই চলে। যে দুএকটা দোকানে বার্মিজ ভাষায় লেখা সাইনবোর্ড। এমন একটি নীরব সুনসান বাসস্ট্যান্ডের কথা চিন্তা করা যায় বাংলাদেশে!
বাস থেকে নামতেই ঘিরে ধরল একদল তরুণ। সবারই একই প্রশ্ন- কোন হোটেলে যাবেন? ট্যাক্সি লাগবে? বাগানে আমি কোন হোটেল বুকিং করিনি। নিয়ত করেছি, পুরোদিন ঘুরে দেখবো বাগান। রাতের বাস পেলে চলে যাবো মান্দালয়। চারপাশ থেকে কর্ণকুহরে ভেসে আসা প্রশ্নের গুঞ্জন উহ্য করে আমি ঢুকে পড়লাম এলিট সার্ভিসের কাউন্টারে। সেখানে চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছেন কয়েকজন। কাউন্টারে বসে সদ্য ঘুমভাঙা চোখে পিট পিট করে যাত্রীদের দেখছেন ম্যানেজার। সোজা তার কাছে গিয়ে বললাম, আচ্ছা এখানে কি লোকাল ট্রান্সপোর্ট সহজলভ্য? তিনি মাথা দুলিয়ে বললেন- না। পাল্টা প্রশ্ন করলেন- তুমি কি কোন হোটেল বুক করেছো? এবার আমি মাথা নাড়িয়ে বললাল- না। কণ্ঠে বিস্ময়ের সুরে তুলে জানতে চাইলেন- তাহলে কোথায় যাবে? এবার মাথা দোলানোর সুযোগ নেই। আধা ইংরেজি আধা ইশারা ভাষায় বললাম, বাগানে রাত কাটানোর পরিকল্পনা আমার নেই। দিনভর ঘুরে রাতের বাসে মান্দালয় যেতে চাই। কি উপায়? এখান থেকে কি মান্দালয়ের রাতের বাস পাওয়া যায়? তিনি ওকে শব্দটির পুনরুক্তি করতে করতে হাতের ইশারায় টার্মিনালের পূর্বপ্রান্তের একটি কাউন্টার দেখিয়ে দিলেন। বললেন, বাগানে লোকাল ট্রান্সপোর্ট সুবিধা নেই। হোটেল বুক করলে সে হোটেল থেকে দিনচুক্তিতে ইলেকট্রিক বাইক ভাড়া নিতে পারো। অন্যথায় তোমাকে ট্যাক্সি ধরতে হবে।
মালয়েশিয়ার মালাক্কা ঘুরতে গিয়ে একবার বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল। বাস কাউন্টারের লোকগুলোই প্ররোচিত করছিল ট্যাক্সিধরার। পরে জেনেছিলাম কমিশনের জন্যই তারা নিজেদের বাসের পাশাপাশি ট্যাক্সির দালালি করে। কিন্তু বাগানের এ নিরিবিলি টার্মিনালে এলিট সার্ভিসের কাউন্টার ম্যানেজারকে তেমন দালাল মনে হয় না। তবুও নিজের মতো করে আরেকটু খোঁজ নিতে দোষ কি!
বাস থেকে নেমেই দেখলাম একটি সাত-আটজনের একটি দল বাক্স পেটরাসহ চড়ে বসল সেখানে অপেক্ষমান একটি মিনি বাসে। কথাবার্তায় বুঝতে পারলাম তাদের নির্ধারিত হোটেল থেকেই পাঠানো হয়েছে এ মিনিবাস। অন্যরাও এক দুইজন করে ট্যাক্সি ধরে যে যার গন্তব্যে চলে গেল। কাউন্টার থেকে বের হতেই ট্যাক্সিওয়ালারা ফের জেঁকে ধরল। জটলা পাকিয়ে যাত্রীদের হোটেল বুকিং আর বাগান দর্শনেরনানা সুবিধার কথা বলে যাচ্ছেন ।
বাস টার্মিনাল মানেই মনের পর্দায় এক ভীড়-ভাট্টা আর হৈ-হল্লাপূর্ণ অনুসিনেমা। শোয়ে পাই টার্মিনালের শান্ত-স্নিগ্ধ ভোর যেন নির্জনতাপিয়াসী পর্যটকদের স্বাগত জানায় পবিত্র প্রাচীন বাগানে। শোয়ে পাই হাইওয়ে বাস টার্মিনালটি বেশ বড়, পরিচ্ছন্ন ও ফাঁকা। সাজানো-গোছানো প্রতিটি কাউন্টারের সামনেই রয়েছে ফুলের গাছ। শোভাবর্ধন করছে তাল গাছের সারি। ঢালাই করা মেজেতে চিহ্নও নেই ধুলোবালির। একপাশে সারিবদ্ধ খাবার হোটেল আর স্যুভেনির, শোপিসের দোকান। টার্মিনালে প্রবেশ এবং বেরুনোর পথে রয়েছে নিজস্ব চেকপোস্ট আর টোলবক্স।
খেয়াল করলাম আমার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে যাচ্ছে একটি ছেলে। পোশাক-পরিচ্ছেদেও অন্যদের থেকে আলাদা। কথা বলছে পরিচ্ছন্ন ইংরেজি উচ্চারণে। তার চোখে মুখে জড়িয়ে আছে এক ধরনের লাজুকভাব। পেশাদার ট্যাক্সিওয়ালা মনে হচ্ছে না কিছুতেই। মনের ওপর ভরসা রেখে তার সঙ্গেই শুরু করলাম বাতচিত। তোমার নামটা কি বলবে? ছেলেটি হেসে বলল- প্রভু। বাংলায় প্রভু নামের অর্থ মনিব-ঈশ্বর। কিন্তু হিন্দিতে প্রভু শব্দের সঙ্গমে ছেলেদের বহু নাম আছে। প্রভু নামটি শুনেই আমার বলিউডের বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী প্রভুদেবার কথা মনে পড়ল।
ব্রাদার প্রভু, আমি কম খরচে বাগান ঘুরে দেখতে চাই। তুমি আমার কি উপকার করতে পারো? প্রশ্নটি করেই আমি তার মুখের দিকে তাকাই। সে উৎসাহের সঙ্গে বলল, তুমি ট্যাক্সি নিতে পারো। আমি খুব সস্তায় ব্যবস্থা করে দেবো। বুঝলাম, সে তার যাত্রী ধরার লাইনেই আছে। এবার আমি নিস্পৃহ ভাব দেখিয়ে বলি, দেখো- মাত্র একদিনের জন্য বাগান ঘুরতে এসেছি। আমি সৌখিন পর্যটক নই। পকেটভর্তি অর্থকড়িও নেই। সংবাদপত্রে কাজ করি, আমাকে ঠিক খরুচে পর্যটক ভাইবো না। আমার কথা শুনে ছেলেটির লাজুকভাবটি আরও বেড়ে যায়। আঙুলের সঙ্গে শার্টের ঝুল মোচড়াতে মোচড়াতে বলে, তাহলে কিভাবে ঘুরতে চাইছো?
বললাম, আমি আসলে জানতে চাইছি লোকাল ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা কি আছে। এবার সে ঠিকঠাক সমঝে ওঠে। সাতসকালে প্রথম ট্রিপ নিশ্চিত না হওয়ায় কিছুটা হতাশাও ফুটে ওঠে তার চেহারায়। প্রভু ধরেই নিয়েছে আমি তার প্যাসেঞ্জার হচ্ছি না। তবু চেহারায় লাজুকভাব ধরে রেখে বলে, প্রথমত বাগানে লোকাল ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা নেই। তোমার বেড়ানোর দুইটি পথ- হয় তোমাকে ট্যাক্সি রিজার্ভ করতে হবে, নইলে ইলেকট্রিক বাইক। কোন হোটেলে না উঠলে ইলেকট্রিক বাইক পাবে না। কারণ নিজেদের বোর্ডারদের জন্য এ ব্যবস্থা রেখেছে হোটেলগুলো।
পর্যটন এলাকায় স্বাভাবিকভাবেই চড়া হয় ট্যাক্সিভাড়া। ভাবছিলাম, লোকাল ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করে ঘুরে দেখব। সাতসকালেই সে আশায় গুড়েবালি। তবু অযথা দ্বিধাদ্বন্দ্ব আমাকে ঘুর্ণাবর্তে চক্র কাটায়। সিদ্ধান্ত নিই বাগান গিয়ে দুপুর পর্যন্ত ঘুরবো নিজের মতো করে। বলি, আমাকে যে কোন একটি বিখ্যাত মন্দিরে নামিয়ে দিতে পারো? পরে কোথায় যাবো সেটা পরের ব্যাপার। প্রভুকে দেখতে বেশ মায়া মায়া লাগে। ভাতৃবোধ জাগে! আমি তার পিঠে হাত রাখি। বলি, কী- নেবে কি কোন মন্দিরে?
প্রভুর মর্জি হয়। মিস্টি হেসে বলে, কেন নয়? ভাড়ার মুসাবিদা তো হলো না। তো প্রভু, কত দিতে হবে? ওনলি ফোর থাউজেন্ড কিয়েট। প্রভুর মুখ দেখেই আন্দাজ করা যায় সর্বনিম্ম ভাড়াই চেয়েছে সে। তার মতো মিস্টি হাসি আমার নেই, তাই মুখে প্রসন্নতার রেখা ফুটিয়ে বলি, লেটস গো।
পরক্ষণেই বলি, আচ্ছা প্রভু- আমি রাতের বাসে মান্দালয় যেতে চাই। বাস কি মিলবে? প্রভু বলে, মিলবে বাস কিন্তু আগেভাগেই টিকেট কাটতে হবে । চার ঘণ্টার বাস যাত্রা। তোমাকে মধ্যরাতে নামিয়ে দেবে মান্দালয়ে। তুমি চাইলে এখনই কেটে নিতে পারো টিকেট। এত্ত সকালে রাতের বাসের টিকিট! প্রভুর পিছু নিয়ে উল্টো পাশের এক কাউন্টারে গেলাম। শান্ত স্নিগ্ধ ভোরে কাউন্টারে খাতা মেলে বসে আছেন এক নারী। তার সঙ্গে প্রভুর বার্মিজ ভাষার বাতচিতে আমার ভূমিকা হল দর্শক শ্রোতার। রেঙ্গুন অং মিনগালার টার্মিনালের আবদুল মাবুদ যেন বাগানে ভর করেছে প্রভূর ওপর। বাতচিত শেষ হলে প্রভু আমাকে ইংরেজি বলল, সন্ধ্যা পাঁচটা, ছয়টা, সাতটায় তিনটি বাস যাবে। আর শেষ বাসটি শোয়ে পাই ছেড়ে যাবে রাত ঠিক দশটায়। রাতের বাসটি এসি, পথে একবার বিরতি দেবে, ভাড়া নেবে সিক্স থাউজেন্ড ফাইভ হান্ড্রেড। সময় হিসেব করে দেখলাম প্রথম বাসে গেলে মান্দালয়ে হোটেলেই উঠতে হবে। আর শেষ বাস ধরলে পৌঁছাবে মধ্যরাতে। ঘণ্টা দুই অপেক্ষার পর ফুটবে ভোরের আলো, সাতসকালে ব্যবস্থা হয়ে যাবে নগর আর মন্দির দর্শনের ব্যবস্থা। হোটেলে উঠলে অর্থের চেয়ে সময়ের খরচটা হবে বেশি। হোটেলের আরামদায়ক বিছানা পেলে সকাল সকাল সে বিছানা ছাড়া মুশকিল হয়ে যাবে। অতএব লাস্ট বাসই সই। মান্দালয় যাবার টিকেটটা হাতে নিয়ে প্রাণে চাঞ্চল্য জাগে। এবার নিশ্চিন্তে বেড়ানো যাবে দিনভর।
মান্দালয়ের টিকেটটা পকেটে পুরতেই প্রভু একটি হাঁক দিল। এতক্ষণ খেয়ালই করিনি বাইরে তখন আমাদের অপেক্ষা করছিল আরেকটি তরুণ। ছেলেটি এগিয়ে এসে বলল, চলেন। পরক্ষণে টার্মিনাল চত্বরে দাঁড়ানো একটি মাইক্রোবাসের দরোজা খুলে দিয়ে ছেলেটি গিয়ে বসল ড্রাইভিং সিটে। টার্মিনাল ছাড়িয়ে ডিভাইডার দেয়া ডাবলওয়ে রাস্তা ধরে উত্তরমুখী ছুটে চলছে গাড়ি। আমি আর প্রভূ বসে আছি পাশাপাশি। কিছুদুর যাওয়ার পর প্রভু বলল, আমি তোমাকে বাগানের বিখ্যাত সোয়াজিগন প্যাগোড়ার সামনে নামিয়ে দেব। আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালে সে লাজুক ভঙ্গিতে বলল, দেখো- বাগান একেবারে ছোট জায়গা নয়। মন্দিরগুলোও ছড়ানো ছিটানো। তুমি হেটে দু’চারটির বেশি দেখতে পারবে না। একা ঘুরলে তোমার চিনতেও অসুবিধা হবে। হোটেল থেকে ইলেকট্রিক বাইক নিয়ে ঘুরতে চাইলে ভাড়া গুনতে হবে এইট থাউজেন্ড কিয়েট। আবার বাইকে ঘোরার ঝক্কিও কম না। টেরই পাবে না কখন চার্জ ফুরিয়ে যাবে। পথে যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দিলে টেনে নিতে হবে বাকী পথ। বিখ্যাত মন্দিরগুলো খুজতে খুজতেই তোমার দিন পেরিয়ে যাবে। আমি শুনছি কিন্তু কোন জবাব দিচ্ছি না। প্রভু বলেই যাচ্ছে, যেতে তোমার চার হাজার যাচ্ছে, ফিরতেও গুনতে হবে চারহাজার। ইলেকট্রিক বাইক ভাড়া আট হাজার কমসে-কম। তুমি চাইলে আমি বেশ সস্তায় দিনভর এ গাড়ি নিয়ে ঘোরার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। সব মিলিয়ে খরচে খুব একটা তারতম্য হবে না। শুনতে শুনতে ভাবলাম, প্রস্তাব মন্দ নয়। কিন্তু বেশ সস্তার খরচটি কেমন হবে!
প্রভু, আমি তোমার প্রস্তাবটি বিবেচনা করতে চাই। কিন্তু তুমি কি খরচের সংখ্যাটা আমাকে বলবে?
আমার সাড়া পেতেই প্রভুর চেহারায় যেন রাজ্যের লাজুকতা এসে ভর করে। খুবই বিনীত স্বরে বলে, এ ট্যাক্সি নিয়ে তোমাকে সারাদিন ঘুরিয়ে দেখাব তার জন্য খরচ পড়বে ওনলি থার্টি ফাইভ থাউজেন্ড কিয়েট। হিসাব করে দেখলাম, বাংলাদেশের টাকায় মাত্র আড়াই হাজার। সত্যিই বেশি চায়নি সে। বাগান ঘুরতে এসে কয়েকশ টাকা বাঁচানোর জন্য বেশিরভাগ মন্দির না দেখে যাওয়া হবে নিবুর্দ্ধিতা। প্রভু তাকিয়েই ছিল আমার মুখের দিকে, ঘাড় ফিরিয়ে বললাম- ওকে, আই অ্যাগ্রি। প্রভু যেন এবার একটু সাহসী হয়ে ওঠল। আমার চোখে চোখ রেখে মুচকি হেসে বলল, অ্যানাদার টুয়েন্টি ফাইভ থাউজেন্ড কিয়েট ব্রাদার। আমি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকাতেই বলল- আমাকে নয়, আমাকে নয়, টুরিস্ট টিকিট কাউন্টারে দিতে হবে। তুমি তো মন্দিরের ভেতরে যাবে তাই না? এ জন্য তোমাকে বাগান আর্কিওলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টের একটি টিকিট কাটতে হবে। এক টিকিটেই সবখানে যেতে পারবে তুমি। অন্যথায় বিখ্যাত মন্দিরগুলোর ভেতরে যেতে দেবে না।
এত্তো টাকা! প্রায় পৌনে দুহাজার। এতো দেখছি, তাজমহলের চেয়ে বেশি। কিন্তু উপায় নেই, তাই প্রভুর পিঠ চাপড়ে আশ্বস্ত করলাম। মনের মধ্যে কেমন যেন এক ধরনের অস্বস্তি বুদ্বুদ তুলছে। আমার সঙ্গে কথা হলো প্রভুর। কিন্তু গাড়ি চালাচ্ছে অন্য ছেলেটি। অস্বস্তি না রেখেই বললাম, এ গাড়ি কি তোমার? আমার প্রশ্ন শুনেই প্রভু তার ট্রেডমার্ক লাজুক হাসি দিয়ে বলল, আমি ড্রাইভার না। মান্দালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি। ছুটিতে বাড়ি এসেছি। যে কয়দিন আছি, সকালে ট্যাক্সির দালালী আর গাইডের কাজ করি। আমি উৎসাহ দিয়ে ফের তার পিঠ চাপড়ে দিই।
একটি ত্রিমোহনায় গাড়ি থামাল ছেলেটি। গঞ্জের বাজারের মতো দোকানপাট। আসলে সাপাদা পায়া ক্যাঙকে ঘিরে তৈরি হয়েছে ত্রিমোহনা। চায়ের দোকানে বেঞ্চিতে পা তুলে ধোয়া উঠা কাপে চুমুক দিচ্ছেন গঞ্জের লোকজন। প্রভু চায়ের অফার করলে আমি না করি না। দোকান থেকে ড্রাইভার ছেলেটিই চা নিয়ে আসে দুকাপ। আমি চায়ে চুমুক দিয়ে সিগারেট ধরাই।
সিগারেটের ফিল্টারটি রাস্তার পাশে ছুড়ে ফেলতেই দুঃসংবাদের মতো প্রভু বলল, আপনার বাগান ভ্রমণ আনন্দদায়ক হোক। এবার তাহলে আমি আসি। আমার প্রশ্ন আর বিস্ময়মাখা চাহনী দেখে প্রভু বিনীত স্বরে আমাকে আশ্বস্ত করে বলল, ওর নামে বেবি। আমার বন্ধু। সে ভালো গাড়ি চালায়, বাগানের প্রতিটি মন্দির তার নখদর্পনে, আমার চেয়ে বেশিই চেনে জানে। কিন্তু ইংরেজিটা ভালো বলতে পারে না। কিন্তু আপনার কোন অসুবিধাই হবে না। সে যত্নের সঙ্গে তোমাকে সারাদিন ঘুরিয়ে দেখাবে আর সন্ধ্যায় টার্মিনালে পৌছে দেবে। তোমার কথা শুনে আমার মনে হলো, আলাদা করে গাইড হিসেবে তোমার থেকে চার্জ নেয়াটা উচিত হবে না। এখন তোমার গাড়ি ভাড়াই দিতে হবে কেবল। বেবিই গাইডের কাজ করবে। বিশ্বাস রাখতে পারো, তোমার কোন সমস্যাই হবে না। কথার এক ফাঁকে আমার হাতে বাগানের দর্শনীয় মন্দিরগুরোর একটি ম্যাপ ধরিয়ে দেয় সে। বার্মিজ ভাষায় বেবিকে নির্দেশনা দেয় আর সে মাথা নেড়ে নেড়ে প্রভুর প্রতিটি কথায় সায় দেয়। যাবার আগে আমি তার সঙ্গে দিনের প্রথম দৃশ্যটি বন্দি করি আমার মোবাইল ফোনে।
বেবি গাড়ি স্টার্ট করলে প্রভু হাত নেড়ে আমাকে বিদায় জানায়। সাপাদা পায়া ত্রিমোহনা থেকে গাড়ি বামদিকে মোড় নিলে আমার ভাবনাও মোড় নেয়। প্রভুর ওপর ভরসা রেখেছিলাম, কিন্তু এতটা তো চাইনি। আমার কিছুটা অর্থ সাশ্রয় করে দেবার জন্য ছেলেটি স্যাক্রিফাইস করে দিল তার একটি দিন! গাইড হিসেবে কাজ করলে নিশ্চয়ই কম বেশি হাজার খানেক টাকা রোজগার হতো তার। নিজের দেশের কথা মনে হয়। বাংলাদেশে এত সুন্দর সব দর্শনীয় জায়গা কিন্তু বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা নগন্য। আমাদের পর্যটকবান্ধব ম্যানেজমেন্ট, যোগাযোগ ব্যবস্থা তো নেইই কোন স্পটে কি প্রভুদের মতো ইংরেজি জানা, সহজ-সরল গাইড আছে! আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে বাবার পকেটে। কখনো কি এসব বিকল্প আয়ের কথা তাদের ভাবনায় আসে? আসবেই বা কোত্থেকে আমাদের দেশে তো পর্যটকই চোখে পড়ে না।