ইয়াসির আরাফাত (মরক্কো থেকে ফিরে)
মুসলিম বীর যোদ্ধা ইউসুফ বিন তাশফীনের শহর মারাকেশ ভ্রমণের শখ ছিল বহুদিনের। অবশেষে ২০১৮ এর জানুয়ারিতে সেই শখ পূরণ হলো। করোনার এই অলস সময়ে ঘরবন্দি জীবনে আপনাদের সঙ্গে সেই ভ্রমণের অভিজ্ঞতাই শেয়ার করব। যুক্তরাজ্য থেকে আমি হাওয়াই জাহাজ চেপে মরক্কো পৌছাই।
বিমান থেকে নামার পর পরিছন্ন এয়ারপোর্ট এবং উন্নতমানের সেবা দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। আফ্রিকার একটি দেশের এয়ারপোর্ট এত সুন্দর হতে পারে তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। ইউরোপের অনেক এয়ারপোর্টও এত সুন্দর ও গুছানো নয়। মারাকেশ শহরের আয়ের প্রধান উৎস হচ্ছে পর্যটন। তাই এ বিষয়ে প্রশাসনের বেশ তদারকি রয়েছে। কোন ধরণের ঝামেলা ও হয়রানি ছাড়াই শুধুমাত্র একটি ফর্ম পূরণ করে তা জমা দিয়ে ইমিগ্রেশন পার হলাম। ইউরোপিয়ান পাসপোর্ট থাকার একটি বিশাল সুবিধা হচ্ছে পৃথিবীর প্রায় অধিকাংশ দেশই ভ্রমণ করা সম্ভব ভিসা ছাড়া অথবা অনেক ক্ষেত্রে ভিসা দরকার হলেও সেটি এয়ারপোর্ট থেকেই নেয়া সম্ভব।
যাই হোক ইমিগ্রেশন পার হবার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলাম পর্যটকদের সেবার জন্য প্রশাসন ভালোই চেষ্টা করে যাচ্ছে। দরজার ঠিক সামনেই একজন নারীকে দেখলাম দাঁড়িয়ে রয়েছে বিনামূল্যে নতুন সিম বিক্রয়ের জন্য। ভিতরে সামান্য ক্রেডিটও রয়েছে। তবে সিম নিলেও আমার কোন কাজে আসেনি। কারণ, আমার আইফোনের সিম ব্লক করা ছিল এবং এই কারণে কতটা ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে সেই কথা একটু পরেই বলছি।
এয়ারপোর্টের ভিতরে থাকা অবস্থাতেই ওয়াইফাই ব্যবহার করে ম্যাপ দেখে নিয়েছিলাম যে শহরের মেইন স্কয়ারের কাছেই আমার রিয়াদ। মারাকেশের অধিকাংশ হোটেলগুলোকেই রিয়াদ বলা হয়। এর আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে বাগান। অবাক করা বিষয় হচ্ছে শহরের অধিকাংশ হোটেলগুলোতেই খুব সুন্দর সাজানো বাগান আছে। এই বাগানে বসে খাওয়ার ব্যবস্থাও করা থাকে। একটি মজার বিষয় হচ্ছে এই ধরণের প্রতিটি বাগানেরই একটি সাধারণ বিষয় হচ্ছে কমলালেবুর গাছ। পুরো মারাকেশ শহরটিই কমলা গাছে ভরা।
এয়ারপোর্ট থেকে বের হবার পর ট্যাক্সি ঠিক করতে হবে হোটেলে পৌঁছানোর জন্য। এখানে কোন ট্যাক্সি মিটারে চলতে রাজি না। দরদাম করেই উঠতে হবে। কয়েকজন ট্যাক্সি চালকের সঙ্গে দামাদামি করলাম এবং সবাই কমবেশি একই ভাড়া চাচ্ছে। ২০০ দিরহাম দামাদামি করলে ১৮০ দিরহাম (১ মরোক্কান দিরহাম বাংলাদেশি ৮ টাকা) পর্যন্ত দিলে রাজি হয়। আরেকটু দামাদামির পর ১০০ দিরহামে রাজি হলো। তবে ট্যাক্সি হোটেল পর্যন্ত যাবেনা। যাবে শহরের কেন্দ্র জামা-ইল-ফিনা স্কয়ার পর্যন্ত। যেখান থেকে আমার হোটেল পায়ে হাটা দূরত্বে অবস্থিত। অতপর ১০০ দিরহামে ঠিক করা ট্যাক্সিতে উঠে পড়লাম।
মরক্কোতে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার কম। এরা ভালো ইংরেজি বলতে পারেনা। তবে ফ্রেঞ্চে বেশ পোক্ত। মরক্কো এক সময় ফ্রেঞ্চ কলোনি ছিল আর তাই এখানে স্কুল কলেজে ফ্রেঞ্চ শিখানো হয় এবং সবাই খুব ভালো ফ্রেঞ্চ পারে। যদিও সময়ের প্রয়োজনে ইংরেজিও এখন শিখানো হচ্ছে। অর্থাৎ নতুন প্রজন্মের মরোক্কানরা ৩ টি ভাষা শিখে বড় হবে । আরবি (তাদের মাতৃভাষা), ফ্রেঞ্চ এবং ইংলিশ। এ ছাড়াও অনেক মানুষ স্প্যানিশ অথবা ইতালিয়ানও টুকিটাকি পারে।
ট্যাক্সি করে যাওয়ার পথেই বুঝতে পারলাম মারাকেশ শহরের ডাক নাম মনে হয় রেড সিটি বা লাল শহর। কারণ, এই শহরে লাল (টকটকে লাল নয়, হালকা লাল ধরণের) রং ছাড়া কোন ভবন নেই। সব ভবনই লাল রঙের। মারাকেশ পুরাতন শহর দেয়াল দিয়ে ঘেরা। দেয়ালটি নির্মিত হয়েছিল ১১২০ সালে। এই দেয়াল মূলত লাল রঙের এবং দেয়ালের ভিতরকার ওল্ড সিটিও লাল রঙের। আর তাই সামঞ্জস্য রাখতে নতুন শহরও একই ধরণের লাল রং দিয়ে বানানো হয়েছে। অনেক ঐতিহাসিক দেশ এবং শহরই তাদের ইতিহাসকে সংরক্ষণ করার জন্য এই ধরণের নীতিমালা অনুসরণ করে থাকে। যেমন জেরুজালেমের পুরোনো দেয়াল যেই রঙের সেই রং ছাড়া অন্য কোন রঙের ভবন নির্মাণ করা সেখানে আইনত নিষিদ্ধ।
মিনেট বিশেক ট্যাক্সি চলার পর চালক আমাকে নামিয়ে দিলো শহরের প্রাণকেন্দ্র জামা-ই-ফিনা নামক খোলা ময়দানে। এ এক ভিন্ন জগৎ। চতুর্দিকে হাজার হাজার মানুষ, কোলাহল, উট, ঘোড়া, বানর, সাপ আর কত কিছু। ঠিক আমাদের গুলিস্তানের মতো। তবে পার্থক্য হচ্ছে এটি সাজানো গোছানো। এখানে একেকজন একেক কাজ নিয়ে ব্যাস্ত। কেউ খেলা দেখাচ্ছে, কেউ সেই খেলা দেখছে। কোথাও নাচ, কোথাও গান, কোথাও চায়ের আড্ডা, কোথাও ক্রেতা ও খদ্দেরের মাঝে দামাদামি। এ এক হুলুস্থূল অবস্থা। এই হাজার মানুষের ভিড়ে আমি সম্পূর্ণ একা। এটিই ছিল জীবনে প্রথম সলো ট্রিপ বা একা ভ্রমণ। তা-ও আবার আমার পরিচিত দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিবেশে। পুরো বিষয়টা বুঝে উঠতে ৫ মিনিটের মত সময় লাগলো। নিজের মাঝে ফিরে আসার পর এখন আমাকে আমার হোটেলে খুঁজে বের করতে হবে।(চলবে)