রাজত্বহীন রাজার নয়া মহল

দিবাকর

নারায়ণ পান্ডে। গাড়িচালক। নেপালের মহারাজগঞ্জে বাংলাদেশ হাইকমিশনে যাওয়ার পথে লাল দেয়ালের বাড়িটি দেখিয়ে বলল, ‘ইহা পাড় হামারা রাজা রেহেতি হ্যায়।’ (এটা আমাদের রাজার বাড়ি)। ‘কিউ’ (কেন?)। এমন প্রশ্নে পান্ডের উত্তর, ‘উসকা যো ঘাড় থা ও আব মিউজিয়াম বান গাইয়া। আব ও ইহা পাড়ই রেহেতেহে।’ (উনার ঘর জাদুঘর বানানো হয়েছে,উনি এখন এখানেই থাকে)। লাল দেয়ালের চারপাশে উঁচু পাহাড়ে রাজত্ব নেই, তবু রাজা জ্ঞানেন্দ্র আছেন। সদর দরজায় সিপাহশালার অত্যাধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে। বাড়ির চারপাশে মোটাদাগের ফুটপাতে দেশি-বিদেশিরা কৌতুহল নিয়ে দেখেন রাজত্বহীন রাজার নয়া মহল।

নারায়ণহিতি রাজপ্রাসাদ। নেপালের রাজাদের সাবেক রাজপ্রাসাদ এটি। বর্তমানে এটি জাদুঘর

দেশ কেমন চলছে? কোন শাসন ভাল লাগছে? নারায়ণ পান্ডের জবাব দেয়, রাজা হি আচ্ছি থি; সবলোক চোর হ্যায়। নয়া শাসনে খুশি নয় কেউ। সেই প্রচন্ডই কি আর বাবুরামই কি। ষোল বছর গাড়ি চালাচ্ছে নারায়ণ। রাজার আমল থেকেই স্টিয়ারিংয়ে হাত। দেবেশ শর্মা। সুজুকি চালান, দেবেশ স্বপ্রণোদিত হয়ে রাজশাসনের প্রশংসা করল। নারায়ণ পান্ডে আর দেবেশ শর্মা। দু’জনই কান্তিপুর, ভক্তপুর, পাঠান এলাকায় ট্যাক্সি চালান। বয়স পঞ্চাশ পার হওয়া এরা দেখেছে রাজার শাসন। কমিউনিস্ট মাওবাদীদের উত্থান। রাজতন্ত্রের বদলা গণতন্ত্র। সবশেষ দেশের শান্তি ফিরিয়ে আনতে রাজনৈতিক দলগুলোর শান্তিচুক্তি। তাদের কথা ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেনি নেপালের। শাসন বদলেছে। অন্তর্ঘাতে রাজ পরিবার ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু দুনিয়ার একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্রের তকমা কাটেনি নেপালে। রাজধানী শহর কিংবা দূর পোখারার ভেলি যেখানেই চোখ গেছে দেব মন্দির আর বুদ্ধ স্টুপার ভিড়। ঐতিহ্য আর অহঙ্কার যা তা তো রাজ দরবারের গুণকীর্তন। কাঠমান্ডুতে হনুমান ঢোকা দরবার স্কয়ার, ভক্তপুর আর ললিতপুরের পাঠান দরবার স্কয়ার চিরচেনা নেপাল। এ যেন রাজা নেই। আবার রাজা আছে।

নেপালের সকালও যেন অন্যরকম। স্থানীয়রা পূজা আর প্রার্থনা দিয়ে শুরু করেন দিন। বিদেশি ঋণ আর ভারত নির্ভর অর্থনীতির এই দেশে যুক্ত হয়েছে মাওবাদী কমিউনিস্টের সঙ্গে চীনের দূতিয়ালি। এক মিশ্র শাসনে জেরবার নেপালের ভিত। ছিয়ানব্বইর ফেব্রুয়ারিতে মাওবাদী কমিউনিস্টরা নেপালের ৭৫ জেলার ৫০টিতেই সশস্ত্র বিপ্লব শুরু করলে পুলিশ, সেনাবাহিনী, সাধারণ মানুষসহ অন্তত ১৩ হাজার লোক নিহত হন। অন্যদিকে, ২০০১-এ ঘটে রয়্যাল পরিবারে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। যুবরাজ দীপেন্দ্র রাজা বীরেন্দ্রসহ পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যকে হত্যা করে। রাজা বীরেন্দ্রের ভাই জ্ঞানেন্দ্র রাজ আসনে বসলেও ততদিনে রাজশাসনের বিদায় ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছে। একই বছরের জুলাইতে শের বাহাদুর দেওবা জরুরি অবস্থায় শান্তি আলোচনা শুরু করলে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। আসে সংসদীয় শাসনের নয়া ভিত।

রাজার নতুন ঠিকানা, নাগার্জুন প্রাসাদ

২০০৬-এ ছাত্র জনতা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু করলে রাজশাসন চিরবিদায় নেয়। নতুন সংবিধান রচনার ডাক আসে। নানা অভিজ্ঞতার বাঁকে নেপালে এখন কোয়ালিশন সরকার। তাতেও স্বস্তি নেই। প্রচন্ডরা এক দশকের সশস্ত্র বিপ্লবে নেপালের রাজশাসনের ঝান্ডাকে বিদায় জানালেও নেপালে শান্তি ফিরে আসেনি। এখনও শেষ হয়নি হাজার হাজার মাওবাদী তরুণ গেরিলাদের সেনাবাহিনীতে একত্রীকরণ। খোদ কোয়ালিশনের শরিকদের মধ্যেই বিতর্ক রয়েছে মাওবাদী গেরিলাদের সেনাবাহিনীতে একত্রীকরণে। ফিরিয়ে দেয়া হয়নি উচ্ছেদ হওয়া মালিকদের ভূমি। মালিকানা ফিরে পেতে আন্দোলন জোরদার হচ্ছে দিনদিন। কমিউনিস্টদের লাল ঝণ্ডার মধুচন্দ্রিমার কালও কেটে গেছে। গেরিলাদের রাজশাসনের বিরোধিতার তীব্রতা আর মূল্যস্ফীতির কাছে পরাজিত নেপালের অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলা যে এক নয় তা হারে হারেই টের পাচ্ছেন বিপ্লবী মাওবাদীরা। দেশটিতে নেই নয়া কর্মসংস্থান আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। যে দেশের চল্লিশ ভাগ মানুষ দরিদ্র। যাদের অর্থনীতির প্রাণচঞ্চল পর্যটনের ওপর। নেপালের শান্তির ভিত এখনও নড়বড়ে।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন