পার্থ চক্রবর্তী, পশ্চিমবঙ্গ থেকে
‘ধুর ফালতু, সুন্দরবনে কিচ্ছু নেই।’ ক্যানিং প্ল্যাটফর্মে কথাটা কানে যেতেই ঘুরে তাকাই। এক মাঝবয়সি ভদ্রলোক কাকে ফোন করে হতাশা উগরে দিচ্ছেন। কান পাততেই বুঝলাম, ইনি চিড়িয়াখানা দেখতে এসেছিলেন, জঙ্গল না। আশায় ছিলেন হরিণ, কুমির, বন্যপ্রাণীর দল তাকে স্বাগত জানাতে দলবেঁধে দাঁড়িয়ে থাকবে নদীর চড়ায়। জঙ্গল থেকে হলুদ কালো ডোরাকাটা রাজামশাই পোজ দেবে। আর তারা ছবি তুলবেন, ভিডিও করবেন। আর তা না হতেই মেজাজ বিগড়েছে। আমার মনে হল বাঘ বিনা তার সফরখানা যেন ষোলো আনাই মাটি। মনে মনে বললাম, যদি বাঘ দেখতে চান, তো চিড়িয়াখানায় যান। সুন্দরবন আপনাকে খুশি করতে পারবে না। তাহলে সুন্দরবন যাব কেন? মূলত প্রকৃতিকে চিনতে হলে, জল-জঙ্গল-মানুষের অপূর্ব জীবন সমন্বয় দেখতে চাইলে আপনাকে সুন্দরবন আসতেই হবে। প্রকৃতির টানে ২০১৯-এর ২০ থেকে ২২ ডিসেম্বর গ্রুপ ট্যুরে সুন্দরবন গিয়েছিলাম। আমাদের সুন্দরবন অভিযান শুরু হয়েছিল শিয়ালদা থেকে। শিয়ালদা সাউথ থেকে ক্যানিং। সেখান থেকে অটো করে সোনাখালী। সেখান থেকে লঞ্চে ওঠা। উদ্দেশ্য সুন্দরবন।
এখান থেকে ভ্রমণ শুরু। ছোট্ট নদী নৌকা করে গ্রামের মানুষ পার হচ্ছে। দলে দলে স্কুলের ছেলে মেয়ে চলেছে নদী পেরিয়ে স্কুলে। আমাদের স্কুল বাসের মতো ওদের স্কুল বোট। লঞ্চ এগোচ্ছে, নদীর তীর ঘেঁষা ছোট ছোট গ্রাম, পাকা বাড়ি নেই বললেই চলে। বাহুল্যহীন সরল জীবন যাত্রা। লঞ্চ এগোচ্ছে আর দুদিকে গ্রাম কমছে, সবুজ বাড়ছে। শ্বাস-প্রশ্বাসে মিশে যাচ্ছে বিশুদ্ধ অক্সিজেন। ট্যুর গ্রুপের লুচি, তরকারি মিষ্টি কফি দেওয়া হল। নদীর বাতাস খিদের উদ্রেক করে। চোখ বন্ধ করে খেয়ে ফেললাম পুরোটাই। ডেকের ওপর ব্যান্ডের দল সুর তুললো ফোক, বাউল, ভাটিয়ালির ছন্দে লঞ্চ ছুটছে ভুট ভুট একটানা শব্দে। জল আর সঙ্গীত মিশে যাচ্ছে ছলাৎ ছলাৎ ধ্বনিতে।
প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে সূর্য কখন মাথার ওপর চলে এসে ঠেকেছে বুঝতে পারিনি। সম্ভিত ফিরে পেলাম ট্যুর মেম্বারদের ডাকে। লঞ্চের ডেকের ওপরে জল, জঙ্গল দেখতে দেখতে চিংড়ি, ভেটকি,আমোদি মাছের ফ্রাই, সবজি ডাল, সুগন্ধি চালের ভাত খেতে খেতে একটা রাজকীয় অনুভূতি টের পাচ্ছিলাম। খাবার পর কেউ কেউ লঞ্চের সুসজ্জিত কেবিনে গড়িয়ে নিল। আমরা বসলাম লঞ্চের সামনে। চালক খুব আলাপি। নানান গল্প তার থেকে শুনতে থাকলাম আর একটু একটু চিনতে থাকলাম বাদাবনকে। কেমন করে আইলা এসেছিল, ডাকাতরা কোথায় থাকে, মধু ভাঙে কেমন করে, মাছ ধরে কারা, তারপর আসে বাঘের গল্প। সে পরপর শুনিয়ে যাচ্ছিল গ্রামে বাঘ আসার গল্প, কাকে কেমন করে বাঘে নিলো সেই কাহিনী।
হঠাৎ নদীর একটা বাঁক। পাশের জঙ্গলে একটা বড় বোর্ড। তাতে লেখা welcome to the area of Royal Bengal Tiger . চালক বললো, বাঘের জঙ্গলে শুরু হল। গা ছমছম করে উঠল। তিনি বলে চললেন, বাঘের সাঁতার কাটার ক্ষমতার কথা, বাঘের আক্রমণের কাহিনী, কেমন করে ঘাড়ের পিছনে থাবা দেয়। এখানে গ্রামে বাঘের আক্রমণ রুখতে জঙ্গল ঘেরা দড়ির জালে। এখানে বাঘে মানুষে একসঙ্গে বসত করে। জলে ঘুরে বেড়ায় কুমির। নদীর দুধারে তখন ঘন বন। শ্বাসমূল উঠে আছে ছুরির মতো। নানান জাতের পাখি ডালে ডালে। চোখ ক্রমাগত খুঁজবে তাকে, বনের রাজাকে। এটাতেই একটা দারুণ আনন্দ। গা ছমছমে পরিবেশ। চালক বলছে, আপনি তাকে দেখতে পাচ্ছেন না। সে কোন ঝোপের আড়াল থেকে নজর করছে আপনাকে। বাঘ খুঁজতে গিয়েই দেখলাম কত রকমের গাছ, হেতাল, গরান, গোলপাতা, গেওয়া,যাদের মাঝেই ধরা আছে জঙ্গলের সৌন্দর্য্য। বাঘ না থাকলে এভাবে জঙ্গলে হয়তো তাকানোও হত না।
এভাবেই ভাসতে ভাসতে একসময় সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ল। মাথার ওপর পাখির ঝাঁক ফিরছে গাছে। দিগন্তের লাল আভা জলে মিশে সৃষ্টি করল এক মোহময় রূপ। লঞ্চ গিয়ে পৌঁছাল পাখিরালা দ্বীপে। দ্বীপটি সুসজ্জিত। এখন ভ্রমণের ভরা মৌসুম। সেই উপলক্ষ্যে বাঁধের ওপর নানা দোকানের পসরা। এখানেই আমাদের হোটেল, এখানে দু রাত থাকা। দারুণ ব্যবস্থা। সকলে মিলে আনন্দে শীতের সন্ধ্যে উষ্ণ হয়ে গেল লোক গানের তালে। পরদিন আসল সুন্দরবন ঘুরে দেখা। সজনেখালি, সুধন্যখালি, দোবাঁকি দ্বীপ ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরবনের বিখ্যাত খাঁড়িগুলো ঘুরে দেখতে থাকলাম। বনবিবি ভারানি, বড়গাজি খালি, চোরাগাজি খালি, মাতলা নদী, আঁধারমারি জঙ্গল দেখতে দেখতে গাইডের থেকে শুনলাম জঙ্গলের নানা কাহিনী, বাঘের স্বভাব, সাপের কাহিনী, বনবিবি, দক্ষিণরায়ের লোককথা, চিনলাম নানা গাছ। শ্বাসমূল, ঠেসমূল, হেতালের ছুরির ফলার মতো মূলের কথা। শুনলাম আইলার রোমহর্ষক কাহিনী। সেখানকার মানুষের কষ্টের কথা। খাবার জল নেই, যোগাযোগের ব্যবস্থা নেই, সাপে কামড়ানোর ওষুধ নেই, কলেজ নেই, কাজ নেই, শুধু নেই নেই আর নেই। এর মধ্যেই মাঝি চিৎকার করে উঠলো বাঁয়ে তাকান চড়ায় কুমির শুয়ে আছে, ডান দিকে দেখুন বুনো শুয়োর, কখনো হরিনের পাল। দুচোখ ভরে দেখছি জঙ্গল।
কে বলে সুন্দরবনে কিচ্ছু নেই। রাত্রে আবার পালা গান। শেষ হলে আলাপ জমাই গাইতে আসা মহিলাদের সঙ্গে। তখন রাত পৌনে দশটা। তারা বলেন, অনেক দূরের গ্রাম থেকে তাঁরা নাচতে-গাইতে আসেন। একেক দলে সাত আট জন। সবাই এসে হোটেলে হোটেলে পালা গান করেন। সবার শেষ হলে নৌকো ছাড়বে। এক ঘণ্টা নৌকায় যাবার পর দেড় ঘণ্টা হেঁটে তারপর পৌঁছবেন বাড়ি। কি করব বাবু, খাবার নেই। ক্লান্ত, শীতে হু হু করতে থাকা মুখগুলি দেখে মনটা খারাপ হয়ে যায়। ডাইনিং থেকে ভেসে আসে সুখাদ্যের গন্ধ, আর কানে ভাসে তাদের দুর্দশার কাহিনী। চিনতে পারি আলো ঝলমলে সুন্দরবনের ভিতরে থাকা আর এক রহস্যময় সুন্দরবনকে।