ভ্রমণে গুরুত্বপূর্ণ ৩ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন নারীরাই

সৈয়দ আখতারুজ্জামান

পৃথিবীতে মোট পর্যটকের সংখ্যা কত? তার কত অংশ পুরুষ আর কত অংশ নারী? প্রতি বছর কি হারে বাড়ছে বা কমছে এই সংখ্যা? আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে বা জিডিপিতে কি প্রভাব ফেলছে এই পর্যটন? সেখানে নারী পর্যটকদের ভূমিকা কতখানি? বাংলাদেশে পর্যটন গবেষণার যথাযথ প্রয়োগ না থাকলেও বিস্তর গবেষণা হচ্ছে দুনিয়াজুড়ে। জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম অর্গানাইজেশন, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম কিংবা ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের গবেষণা ও জরিপ থেকে আমরা বিস্ময়কর তথ্য পাই। ‘বিস্ময়কর’ এই জন্য যে, এই তথ্য আমাদের দেশের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখে বলে মনে হয় না। একটু তথ্য- উপাত্ত আর উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে আশা করি। ইউএনডব্লিউটিওর পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সালে বিশ্বের প্রায় ১.৫ বিলিয়ন পর্যটক ভ্রমণ করেছে যা কিনা ২০১৮ সালের তুলনায় অন্তত ৪ শতাংশ বেশি।

এই বিশাল সংখ্যক পর্যটকের অন্তত অর্ধেক নারী। কোনো কোনো পরিসংখ্যান বলছে, এই সংখ্যা তারচেয়েও বেশি, ৬৩ শতাংশ। ফলে পর্যটনখাতে নারীর ভূমিকা যে কতটা প্রবল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু তাই নয়, পুরুষ পর্যটক যখন ভ্রমণ করে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রধান ভূমিকা রাখেন নারী। ফোর্বস ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ভ্রমণসঙ্গী, ভ্রমণ ব্যয় এবং ভ্রমণ গন্তব্য এই তিন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ ভূমিকা নারীর। এখানেই শেষ নয়, এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রভাবে এ বছর ভ্রমণ ব্যয় হবে আনুমানিক ১২৫ বিলিয়ন ডলার। নারী পর্যটকদের মধ্যে ২৫ থেকে ৩৯ বছর বয়সের নারীরাই সবচেয়ে বেশি (৪৬ শতাংশ)। সুতরাং ২৫ থেকে ৩৯ বছর বয়সের নারীরা পর্যটনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছেন। খুব ভালো হতো যদি আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকরা সিদ্ধান্ত গ্রহণে এই তথ্যগুলোর প্রতিফলন ঘটাতেন।

আমাদের দেশের পর্যটন সম্পর্কে সঠিক তথ্য দেয়ার কোনো উপায় নেই। কিন্তু দীর্ঘদিন এই পেশার সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে যে মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা হয়েছে সে থেকে বলতে পারি, নানা প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের নারী পর্যটকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। যদিও আনুপাতিক হারে পর্যটন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারীর সংখ্যা ততটা বাড়ছে না। এক দশক আগে বাংলাদেশে ট্রাভেল এজেন্সির সংখ্যা ছিল পনের’শ। বর্তমানে সেই সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। এর মধ্যে (শুধু লাইসেন্সের স্বার্থে স্ত্রীর নাম দেয়া হয়েছে যেসব প্রতিষ্ঠানে সেগুলো বাদে) প্রকৃত নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা বিশজনও নয়। বর্তমানে ট্যুর অপারেটরদের এসোসিয়েশন টোয়াবের সদস্য সংখ্যা ৬৭২ জন। তার মধ্যে নারী সদস্য ২০/২৫ জনের বেশি নয়। এতদসত্তে¡ও পরিসংখ্যানগত কারণে বলতেই হবে যে, আমরা এগিয়ে চলছি। কিন্তু বাস্তবতা বড়ই নাজুক।

বাংলাদেশে নারী পর্যটকদের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি ভ্রমণের ধরনও পাল্টে গেছে। দু’একজন ব্যতিক্রম ছাড়া আগে কোনো নারী পরিবার বা আত্মীয়-স্বজন ছাড়া ভ্রমণ করতেন না। কিন্তু এখন প্রচুর সংখ্যক নারী বন্ধুদের সঙ্গে কিংবা সামান্য জানাশোনা আছে এমন গ্রুপের সঙ্গেও একা ভ্রমণ করছেন। এখন বর্তমানে একটা বড় অংশের নারী শুধু নারীদের সঙ্গেই ভ্রমণ করেন এবং তাদের সংগঠনও রয়েছে। বছরের নানা মৌসুমে, ছুটিতে তারা বড় গ্রুপে একসঙ্গে ভ্রমণ করছেন, যেখানে তার পরিবার বা আত্মীয়দের কেউ নেই। অধিকাংশই অপরিচিত বা এই ভ্রমণে এসে পরিচয় ঘটেছে। বিশ্বব্যপী যখন নারী পর্যটকদের সংখ্যা এবং পর্যটন অর্থনীতিতে তাদের ভূমিকা এতটাই প্রবল তাহলে আমাদের দেশে নারী পর্যটকদের এবং বৈচিত্র্যময়তা বাড়ছে না কেন? আলাপ হলো পর্যটন সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে। উঠে এলো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

এক.

নারী পর্যটন আশানুরূপভাবে না বাড়ার প্রধান কারণ নিরাপত্তা। নারী পর্যটক তাই একা ভ্রমণে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। অথচ যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানের জরিপে দেখা গেছে, যে সকল প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র নারী পর্যটকদের সেবা দিয়ে থাকে তাদের ক্রেতাসংখ্যা গত কয়েক বছরের মধ্যেই অন্তত ২৩০ শতাংশ বেড়েছে, যা কিনা এক কথায় অকল্পনীয়। গবেষণা আরো বলছে, দুনিয়াজুড়ে যাই হোক না কেন, ৮৬ শতাংশ নারী পর্যটক বলেছেন, তারা ভ্রমণে ভয় পান না।

দুই.

নির্ভরযোগ্য ভ্রমণসঙ্গীর অভাব আরেকটি কারণ। যদিও নারীরা নানাভাবে ভ্রমণের সুযোগ তৈরি করে নেন, অন্য নারী ভ্রমণসঙ্গী জোগাড় করেন, বা আগের ভ্রমণে পরিচয় হয়েছে এমন নিরাপদ সঙ্গীর উপস্থিতি নিশ্চিত করে ভ্রমণে বেরুচ্ছেন, কিন্তু সেটা প্রত্যেকবার হয়ে উঠছে না। কখনো কখনো ভ্রমণসূচি মেলে না। ফলে নারী ভ্রামণিকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। হয়তো এই ভ্রমণ বছরে একাধিকবার হতে পারতো। অথচ এক জরিপে লক্ষ্য করা গেছে, একা ভ্রমণ করেছেন এমন ৩২ মিলিয়ন আমেরিকান নারী গত এক বছরে অন্তত একবার হলে ভ্রমণ করেছেন। এদের মধ্যে অনেক তিনবার, এমন কি পাঁচ বারও ভ্রমণ করেছেন। ৫৯ শতাংশ নারী পর্যটক পরবর্তী এক বছরে আবারও ভ্রমণ করেছেন।

তিন.

সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টালে আমাদের দেশে নারী পর্যটকদের সংখ্যা আরো বাড়তো। একথা বলা যাবে না যে, আমাদের দেশে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি একদম পাল্টেনি। যারা ভ্রমণ করছেন তারা পরিবার থেকে সাপোর্ট পাচ্ছেন বলেই ভ্রমণ করতে পারছেন। কিন্তু এই ইতিবাচক পরিবর্তন আরো প্রয়োজন। একজন নারী পর্যটক একা বাসে ট্রেনে ভ্রমণ করলে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ফলে সারা বিশ্বে একক নারী পর্যটকের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বাড়লেও আমাদের দেশে বাড়ছে না। বৃটেনের গবেষণা প্রতিষ্ঠান কন্ডোর ফেরিস দারুণ এক তথ্য দিয়েছে, ‘ফিমেল সলো ট্রাভেল’ লিখে ইন্টারনেটে সার্চের পরিমাণ গত তিন বছরে ৬২ শতাংশ বেড়েছে। আমাদের দেশে স্বামী ছাড়া স্ত্রী তার বন্ধুদের সঙ্গে ভ্রমণ করলে নানা প্রশ্ন ওঠে। অথচ আমেরিকার ৬৫ শতাংশ নারী তাদের স্বামী বা পার্টনার ছাড়াই ভ্রমণ করেন। তাই দেশ, সংস্কৃতি ও সামাজিকতা ভেদে এই পরিবর্তনের মাত্রা পাল্টে যায়।

নারীবান্ধব পর্যটন উন্নয়নে একটি দেশের সরকার একা সকল ভূমিকা পালন করতে পারে না। তাই সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও পরিবর্তন, প্রচলন ও পর্যটন সেবা সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিক সহযোগিতা প্রয়োজন। যা সার্বিকভাবে দেশের পর্যটনখাত তথা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে জোড়ালো ভূমিকা পালন করবে। পর্যটন স্থানের আবকাঠামোগত উন্নয়ন, আঞ্চলিক শপিং ব্যবস্থাপনা, অ্যাডভেঞ্চার গন্তব্যগুলোর নিরাপত্তা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থানগুলোকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করা ও সংরক্ষণ ইত্যাদি অগণিত কাজ আছে যা নারীবান্ধব পর্যটন উন্নয়নে আমাদেরকে সম্মিলিতভাবে করতে হবে। ইংল্যান্ডের ২৭ শতাংশ পর্যটন ব্যবসায়ী মনে করেন, যখন নারীরা পর্যটন সেবা নেন তখন দর্শনীয় স্থান দেখা আর শপিং-এর ওপর বেশি জোর দেন। জরিপে দেখা গেছে যারা, যারা অ্যাডভেঞ্চার, কালচার এবং প্রকৃতিনির্ভর ট্যুর বুক করেন তাদের ৭৫ শতাংশই নারী। এবার ইংল্যান্ড, আমেরিকা বা ইউরোপের এই দৃশ্যের মতো এশিয়াতেও একই চিত্র হবে তেমনটা ভাববার কারণ নেই। কিন্তু উল্লিখিত পরিসংখ্যন নারী পর্যটক সম্পর্কে যে ধারণা দিচ্ছে সেটা সারা বিশ্বের পরিসংখ্যানের যে একটা বড় অংশ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সুতরাং আমরা কেন পিছিয়ে থাকব?

লেখক: পর্যটন ও ভ্রমণ লেখক, প্রধান নির্বাহী, বিয়ন্ড এডভেঞ্চার অ্যান্ড ট্যুরিজম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন