ভূমিতে নেমে আসা ড্রাগন

ফাহাদ আহমেদ শিকদার

হালং বে। ভিয়েতনামের কুয়াংনিং প্রদেশের এই ছোট্ট উপসাগরটি সারা পৃথিবীর পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় এক জায়গা। পর্যটনের উদ্দেশ্যে কেউ ভিয়েতনাম সফরে গেছেন আর হালং বে যাননি এমনটা হতেই পারেনা। কারণ, হালং বে দর্শন ছাড়া ভিয়েত নাম সফর অনেকটা সমুদ্র সৈকত ছাড়া কক্সবাজার দর্শনের মতো।  ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয় থেকে হালং বের দুরত্ব মাত্র ১৮০ কিলোমিটার। উপসাগরটির আয়তন ১৫০০ বর্গ কিলোমিটারের মতো। অপরূপ সৌন্দর্য্যরে আঁধার এই উপসাগরটি ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অর্ন্তভুক্ত করে। ২০১২ সালে এটি বিশ্ব প্রাকৃতিক আশ্চর্য হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়।

হালং বে তে লেখক

হালং বের উৎপত্তি সম্পর্কে স্থানীয়দের মাঝে প্রচলিত বিশ্বাস বেশ চিত্তাকর্ষক। ভিয়েতনামী শব্দ হালং এর অর্থ ‘ভূমিতে নেমে আসা ড্রাগন’। প্রাগৈতিহাসিক কালে শত্রু শক্তি ভিয়েতনাম দখল করার চেষ্টা করলে ভিয়েতনামকে রক্ষার জন্য ঈশ্বর একটি ড্রাগনের পরিবারকে পাঠায়। যে স্থানটিতে মা ড্রাগন আসন গ্রহণ করে এর নাম ছিল হালং। ড্রাগনেরা ভিয়েতনামকে রক্ষার উদ্দেশ্যে অসংখ্য দ্বীপ তৈরি করে। দ্বীপগুলো সংঘবদ্ধ হয়ে দুর্ভেদ্য দেয়ালের রূপ ধারণ করে। শত্রুরা আক্রমণ করতে আসলে তাদেও জাহাজগুলো দ্বীপের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। এভাবেই হালং বের উৎপত্তি।তবে ভূতাত্ত্বিকেরা এর উৎপত্তি সম্পর্কে দেন ভিন্নমত। তাদের মতে এই দ্বীপগুলোর উৎপত্তি কমপক্ষে ৫০ কোটি বছর আগে। এরপর দীর্ঘ সময়ে ভূতাত্ত্বিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গঠিত হয়েছে হালং বের আজকের অবয়ব।   শত-সহস্র পাহাড় যেন সমুদ্রের শান্ত নীল জলে ভাসছে।

 তবে এর উৎপত্তি সম্পর্কে প্রাচীন লোকগাঁথা যেমনই হোক প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে হালং বে একাধিকবার ভিয়েতনামের রক্ষা ব্যুহ হিসেবে কাজ করেছে। এখানে অবস্থান নিয়ে ভিয়েতনামের সেনাবাহিনী তিন তিনবার চীনা নৌ সেনাদের প্রতিরোধ করেছে। ১২৮৮ সালে মোঙ্গলীয় শাসক কুবলাই খান তার নৌবহর নিয়ে ভিয়েতনাম আক্রমণ করলে দেশটির সেনাবাহিনী কুবলাইখানের নৌবহরের সলিল সমাধি ঘটায় এই হালং বেতে। একনজরে হালং বে দেখলে মনে হয় শত-সহস্র পাহাড় যেন সমুদ্রের শান্ত নীল জলে ভাসছে।

একনজরে হালং বে দেখলে মনে হয় শত-সহস্র পাহাড় যেন সমুদ্রের শান্ত নীল জলে ভাসছে

প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে হালং বে একাধিকবার ভিয়েতনামের রক্ষা ব্যুহ হিসেবে কাজ করেছে। হালং বেতে যেরকম অজস্র পাহাড় রয়েছে তেমনি এই পাহাড়গুলোতে রয়েছে অজস্র গুহা। গুহাগুলোর মধ্যে বড়টির নাম সাংসত কেভ। রহস্য ও সৌন্দর্য্যরে মিশেলে তৈরি এই গুহাটি বরাবরই পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। উঁচু-নিচু বন্ধুর, সর্পিল ও পিচ্ছিল এই গুহার পথে পথে বিস্ময় ছড়ানো। হাজার বছরের পুরোনো পাথর নানা অবয়বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে গুহাটির প্রবেশ পথে।

গুহায় প্রবেশপথের ডানপাশে পাথর নির্মিত একটি ঘোড়া ও তলোয়ার চোখে পড়ে। এই পাথুরে ঘোড়া ও তলোয়ার ঘিরে একটি লোকগাঁথা প্রচলিত আছে। এই ঘোড়ার আরোহী ছিলেন থানসিয়াং নামের এক ভিয়েতনামী বীর। এই বীর শত্রু শক্তিকে পরাজিত করে ভিতেয়নামী জনগণকে মুক্ত করেছিলেন। শত্রুদের বিতাড়িত করার পর তিনি আকাশে উড়ে গেলেও তাঁর ঘোড়া ও তলোয়ার রেখে যান জনসাধারণের সুরক্ষার জন্য।

কখন যাবেন

হালং বে ভ্রমণের উপযুক্ত সময় মার্চ থেকে মে এবং অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর। এ সময়কালে আবহাওয়া থাকে ভাল। কিভাবে ভিসা করবেন ঢাকা থেকে অন অ্যারাইভাল ভিসা নিয়ে ভিয়েতনামে যাওয়া যায়। এতে এয়ারপোর্টে আধ ঘণ্টা সময় বেশি ব্যয় হবে। কিন্তু আপনার খরচ কমবে। ঢাকা থেকে স্টিকারভিসা নিলে ১০-১২ হাজার টাকা খরচ হবে। কিন্তু অন অ্যারাইভাল হলে ৪হাজার থেকে ৪৫০০ টাকা আর এয়ারপোর্টে ২৫ ডলার। মানে ৬ হাজার থেকে ৬৫০০ টাকার মধ্যে খরচ হবে। এয়ারপোর্টে অন অ্যারাইভাল এর একটা কাউন্টার আছে। ওখান নির্ধারিত ফর্ম সংগ্রহ করে ফিলআপ করতে হবে। এরপর লাইন ধরে জমা দিতে হবে। এই ফর্মটি অনলাইন থেকেও ডাউনলোড করা যায়। বুদ্ধি করে আগ থেকেই ফিলআপ করে রাখলে লাইনের প্রথমেই জমা দেয়া যাবে। ফর্ম এর সাথে এক কপি ছবিও জমা দিতে হয়। একজন বা ফ্যামিলির জন্য একটি ফর্মই যথেষ্ট।

কিভাবে যাবেন

বাংলাদেশ থেকে সরাসরি ভিয়েতনামে কোন বিমান নেই। ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয় যেতে হলে আপনাকে মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুর থেকে ট্রানজিট নিতে হবে। হ্যানয় থেকে বিভিন্ন ট্যুর কোম্পানি বিভিন্ন প্যাকেজ রেখেছে হালং বে-এর জন্য। প্যাকেজের জন্য হ্যানয়-এর হোয়ানকিয়েম লেক এলাকা থেকে ট্যুর প্যাকেজ কনফার্ম করতে পারেন। এখানে শত শত ট্যুরিস্ট এজেন্সি আছে। তাদের কাছে বাহারি রকমের প্যাকেজ। মাত্র ৩০ ডলার থেকে শুরু। ব্যক্তিগতভাবে যেতে চাইলে হ্যানয় থেকে বাস অথবা মিনিবাসে করে যেতে পারেন। মিনিবাসে করে যেতে আপনার খরচ পড়বে ১২০,০০০ ডংবা ৬ ডলার। এছাড়াও প্রাইভেটকার অথবা ট্যাক্সি ভাড়া করে নিতে পারেন। এজন্য প্রতিবারের জন্য আপনাকে গুনতে হবে ৮৫ ডলার। পুরো ট্রিপ অর্থাৎ ২ দিন ১ রাতের জন্য ভাড়া নিলে খরচ পড়বে ১৫০ ডলার। হোটেল হোয়ানকিয়েম লেক-এর আশপাশে থাকার চেষ্টা করবেন। এটি ট্যুরিস্ট এলাকা। এখানে সব কিছু পাবেন। নাইট মার্কেট, রেস্টুরেন্ট, ক্লাব, ট্যুর এজেন্ট সব কিছু। হোয়ানকিয়েম এলাকায় সস্তায় বেশ ভালোমানের হোটেল পাওয়া যায়। ১৫০০-২০০০ টাকার মধ্যে ভাল হোটেল পেয়ে যাবেন। 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন