ভারতীয় ভিসার ক্ষেত্রে করণীয়

প্রায় দুবছরের বেশি সময় বন্ধ থাকার পর অবশেষে চালু হয়েছে স্থলপথে ভারতের ট্যুরিস্ট ভিসা। গতবছরের ১৫ই নভেম্বর ট্যুরিস্ট ভিসা চালু হলেও এতদিন পর্যন্ত শুধুমাত্র বাইএয়ারেই দেয়া হচ্ছিলো এ ভিসা। এখন থেকে বাই এয়ারের পাশাপাশি বাই রোড ও বাই ট্রেনেও ভিসা দেয়া হবে। আগামী পহেলা বৈশাখ থেকে চালু হবার জন্য অপেক্ষায় আছে ভারত-বাংলাদেশের তিনটি ট্রেন। এছাড়া ঢাকার সাথে কলকাতার বাস সার্ভিসও চালু হতে যাচ্ছে।

ভারতের ভিসা করাটা অনেকেই খুবই জটিল মনে করেন। বিষয়টা আসলে কিন্তু তা নয়, বরং নিয়মানুযায়ী আবেদন করলে আপনি সহজেই ভিসা পেয়ে যেতে পারেন। প্রতিদিন প্রায় ১৫,০০০ মানুষকে ভিসা দেয় ভারত। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর অন্তত ১৫-২০ লক্ষ মানুষ ভারতে ঘুরতে যায়, যা ভারতে আগত পর্যটকের ২০ ভাগ। তাছাড়া কম খরচে ঘোরাঘুরি করার জন্য শুধু বাংলাদেশে নয় সারা বিশ্বেই ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য।

ভিসার আবেদনের প্রথম ধাপটি হচ্ছে অনলাইনে ভিসার আবেদন পত্রটি পূরণ করা। এ কাজটি সঠিকভাবে করতে পারলে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ ভিসার আবেদনপত্র নিকটস্থ আইভ্যাক সেন্টারে জমা দিলে মোটামুটি এক সপ্তাহের মধ্যেই আপনি ভিসা পেয়ে যাবেন। আমি চেষ্টা করবো এই পোস্টে একটি পরিপূর্ণ ধারণা দেবার জন্য, কিভাবে, কত টাকা খরচ করে, আপনি ভারতের ভিসার আবেদনের কাজটি শেষ করবেন।

প্রথম ধাপ: অনলাইনে ভারতের ভিসার আবেদন পত্র পূরণ:

ভারতীয় ভিসার প্রথম ধাপ হচ্ছে অনলাইনে ভিসার জন্য আবেদন পত্রটি জমা দেয়া। এ কাজটি যখন করবেন হাতে সময় নিয়ে মনোযোগ সহকারে করবেন, যাতে আবেদন পত্রে কোন ধরণের ভুল না থাকে। বেশির ভাগ ভিসার আবেদনপত্রেই প্রত্যাখান হয় আবেদন পত্রটি ঠিকভাবে পূরণ করতে না পারার কারণে। অনেকে আবার দোকান থেকে বা অন্য কাউকে দিয়ে ফরমটি পূরণ করান, এতে ভুল সম্ভাবনা আরও বেশি থাকে। ভালো হয় আপনি আপনার আবেদন পত্রটি নিজে নিজে পূরণ করলে।

আবেদনপত্র পূরণ করার সময় আপনার কাছে কয়েকটি জিনিস প্রস্তুত থাকা লাগবে। এগুলো হাতের কাছে না থাকলে আবেদন পত্র সেইভ করে রেখে পরে এগুলো নিয়ে আবার বসতে হবে। এগুলো হচ্ছে:

১. পাসপোর্ট (অন্তত ৬ মাস মেয়াদ বাকি থাকতে হবে)

২. ছবির সফট কপি (একই ছবি ২ বাই ২ ইঞ্চি সাইজ আবেদন পত্রের সাথে জমা দিতে হবে)

৩. ভারতের কোন একটি হোটেলের ঠিকানা ও ফোন নাম্বার

আবেদন পত্রটি সঠিকভাবে পূরণ করতে আপনার প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগতে পারে। তাই সেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে বসবেন। এই লিংকে যেয়ে আবেদন পত্রটি পূরণ করবেন। যে সমস্ত তথ্যাদি চাইবে সেগুলো সঠিকভাবে পূরণ করবেন। যেমন, পুরো নাম, পিতা/মাতার নাম, বর্তমান-স্থায়ী ঠিকানা, অফিস/শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তথ্য এসব। 

ভারতে আপনার গন্তব্য অনুসারে কোন পোর্ট দিয়ে যাবেন সেটা নির্বাচন করবেন। বর্তমানে ভারত সবগুলো স্থল বন্দর, আকাশ পথ ও রেলপথের ভিসা দিচ্ছে। উল্লেখযোগ্য পোর্টগুলো হচ্ছে: ১. হরিদাশপুর (বাংলাদেশ অংশে বেনাপোল) ২. ডাউকি (বাংলাদেশ অংশে তামাবিল), ৩. চেংড়াবান্দা (বাংলাদেশ অংশে বুড়িমারী) ৪. বাই ট্রেন গেদে (বাংলাদেশ অংশে দর্শনা) ৫. ফুলবাড়ী (বাংলাদেশ অংশে বাংলাবান্দা। এছাড়া চালু হবার অপেক্ষায় আছে বাই ট্রেন হলিদাবাড়ী। (আপডেট ২/০৪/২২)

অনলাইন আবেদনপত্র পূরণে সাধারণত একটি জায়গায় এসে মানুষ সমস্যায় পরে সেটা হচ্ছে রেফারেন্স কি দেবেন। বাংলাদেশর রেফারেন্স দিবেন এমন কারো নাম ও ফোন নাম্বার যে আপনার সাথে ভারত যাওয়ার সম্ভাবনা কম, এতে করে ভারতে আপনি কোন সমস্যায় পড়লে আপনার বাসায় যোগাযোগ করা সম্ভব হবে। আর ভারতের রেফারেন্স হিসেবে দিবেন যে হোটেলে থাকতে চাচ্ছেন তার নাম, ঠিকানা ও ফোন নাম্বার। এছাড়া একেবারে শেষের দিকে ভারতের কোন জায়গায় কোন হোটেলে থাকবেন সে তথ্যও যোগ করতে হয়। 

এছাড়া আপনার পিতা/মাতা, দাদা-দাদীর নাগরিকত্ব কি ছিলো, এই প্রশ্নের উত্তরে লিখবেন বাংলাদেশ। আবেদন পত্রটি সফলভাবে সাবমিট করতে পারলে আপনি সেটা প্রিন্ট নিবেন। আবেনদপত্রের নির্ধারিত দুটি স্থানে (ছবির নিচে ও শেষ পৃষ্ঠায়) স্বাক্ষর করবেন। আপনার স্বাক্ষরটি পাসপোর্টে দেয়া আপনার স্বাক্ষরের অনুরূপ হতে হবে। আবেদন পত্র প্রিন্ট হয়ে গেলে একটি ২ বাই ২ ইঞ্চি সাইজের ছবি আঠা দিয়ে লাগাবেন, এরপর ভিসার প্রসেসিং ফি জমা দিবেন।

২য় ধাপ: ভিসার প্রসেসিং ফি জমা দেয়া:

আগে ভিসা ফি আইভ্যাকে জমা দেয়া লাগতো, এখন সেটাও অনলাইন করা হয়েছে। এতে একটা সুবিধা হয়েছে আইভ্যাকে আপনার আর সময় নষ্ট হবেনা। ভিসার প্রসেসিং ফি ৮০০ টাকা। এর সাথে বিকাশ বা ব্যাংক চার্জ যুক্ত হয়ে ৮২৪ টাকার মতো খরচ হতে পারে। সাধারণত সব আইভ্যাকে বা এর আশেপাশে আপনি ভিসা প্রসেসিং ফি জমা দিতে পারবেন। 

৩য় ধাপ: প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করা:

এ অংশটিতেই আসলে মূল ঝামেলা। ভারতের ভিসার জন্য বেশ কিছু কাগজপত্র দিতে হবে, সেগুলো ঠিক থাকলে আপনার ভিসা না পাওয়ার কোন কারণ নেই। আসুন দেখি আবেদনপত্রের সাথে কি কি দিবেন:

১. পাসপোর্ট। অন্তত ৬ মাসের মেয়াদ বাকি থাকবে হবে এবং কমপক্ষে দুটো পৃষ্ঠা খালি থাকতে হবে। পাসপোর্টের যে দুটো পৃষ্ঠায় আপনার তথ্যাদি আছে সেগুলোর ফটোকপি দিবেন (পৃষ্ঠা ৩ ও ৪)। পুরণো যতগুলো পাসপোর্ট আছে সেগুলোও অবশ্যই সঙ্গে দিবেন।

২. সদ্য তোলা ২x২ রঙিন ছবি দিতে হবে। ছবিতে পুরো মুখোমণ্ডল দেখা যেতে হবে এবং ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড সাদা হতে হবে। সদ্য তোলা বলতে তিন মাসের মধ্যে তোলা ছবিকে বুঝায়। ছবি অবশ্যই ল্যাব প্রিন্ট হতে হবে।

৩. বর্তমান ঠিকানার স্বপক্ষে একটি প্রমাণপত্র দিতে হবে। কোন ইউটিলিটি বিলের ফটোকপি হলে হবে। যেমন বিদ্যুৎ, ল্যান্ডফোন, পানি বা গ্যাসের বিল। মনে রাখবেন বিলে আপনার ঠিকানা যেভাবে আছে ঠিক সেভাবেই ভিসার আবেদনপত্রে দিবেন।

৪. পেশার প্রমাণ পত্র। চাকুরজীবি হলে অফিস থেকে একটা সনদ দিবেন যেটাতে লেখা থাকবে আপনি কোন অফিসে কি চাকুরী করেন এবং ভারত ভ্রমণে অফিসের কোন আপত্তি নাই। আর ছাত্র হলে স্টুডেন্ট আইডি কার্ডের ফটোকপি দিবেন। অবসরপ্রাপ্ত হলে সর্বশেষ চাকুরী রিজইন লেটার/সম্পন্ন করার সনদ দিবেন।

৫. আর্থিক স্বচ্ছলতার প্রমাণ দেখাতে হবে। এক্ষেত্রে আপনার পাসপোর্টে ব্যাংক থেকে ১৫০ ডলার এনডোর্স করা থাকবে। এছাড়া ব্যাংক স্টেটমেন্ট যেখানে সর্বশেষ ব্যালেন্স ২০,০০০ টাকা আছে, দিলে হবে। আর যদি আপনার ক্রেডিট কার্ড এনডোর্স করা থাকে সেক্ষেত্রে পাসপোর্টের যে পৃষ্ঠায় ক্রেডিট কার্ড এনডোর্স করা আছে সে পৃষ্ঠার ফটোকপি ও ক্রেডিট কার্ডের উভয় পিঠের ফটোকপি দিলে চলবে।

৬. জাতীয় পরিচয়পত্রের উভয় পিঠের ফটোকপি। যদি আপনার জাতীয় পরিচয় পত্র না থাকে তবে জন্ম নিবন্ধনের ফটোকপি দিবেন। মনে রাখবেন আপনার পাসপোর্টের তথ্যের সাথে জাতীয় পরিচয়পত্র/জন্ম নিবন্ধনের তথ্যের মিল থাকতে হবে।

কাগজগুলো কিভাবে সিরিয়ালি সাজাবেন সেটা এই ছবি থেকে দেখে নিতে পারেন। এভাবে সাজিয়ে নিয়ে আপনি নিকটস্থ আইভ্যাকে চলে যাবেন।

শেষ ধাপ: আবেদনপত্র জমা ও পাসপোর্ট সংগ্রহ করা:

আগের কাজগুলো করতে পারলে এখনকার কাজটা খুবই সহজ। আপনার এলাকার জন্য নির্ধারিত আইভ্যাকে যেয়ে সিরিয়াল নিবেন। কাগজপত্র আইভ্যাকের কর্মকর্তারা দেখে আপনাকে একটা টোকেন দিয়ে পাসপোর্ট জমা কাগজপত্র সহ জমা রেখে দিবে। টোকেনে উল্লেখিত দিনে যেয়ে আপনি আপনার পাসপোর্ট ফেরত নিয়ে আসবেন। মনে রাখবেন পাসপোর্ট জমা নেয় সকাল ৯ টা থেকে দুপুর ১২: ৩০ পর্যন্ত (যমুনা ফিউচার পার্কে ১:০০ পর্যন্ত নেয়)। আর পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে যাবেন বিকাল তিনটা থেকে পাঁচটার মধ্যে। বর্তমানে আবেদন করলে পরিবারের সবাইকে যেতে হয় বায়োমেট্রিক ডাটা দেবার জন্য। তবে পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে পারবেন যেকোন একজন।

বাংলাদেশে মোট ১৫ টি আইভ্যাক আছে। এগুলো হচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, কুষ্টিয়া, যশোর, রংপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালী, সাতক্ষীরা, বরিশাল, বগুড়া, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, ঠাকুরগাঁও ও সিলেটে। 

 

লেখক-মুহাম্মদ হুসাইন সবুজ 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন