পাহাড় চূড়ায় বাঘের গুহা

মাহাদী মুনতাসির

টাইগার্স নেস্ট। পাহাড় চূড়ায় এক বিস্ময়কর পবিত্র স্থানের নাম। ভুটান ভ্রমণ অসম্পূর্ণই থেকে যাবে যদি কেউ টাইগার্স নেস্ট না দেখে। শান্ত, সুন্দর সাজানো গোছানো ভুটানের পারো শহরের প্রধান আকর্ষণ টাইগার্স নেস্ট। ধর্ম আর মিথ যদি আপনার আগ্রহের বিষয় হয়ে থাকে, তবে আপনি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন না কেন, টাইগার নেস্ট আপনাকে হাতছানি দেবেই। নাম টাইগার নেস্ট বা বাঘের গুহা হলেও মূলত এটি একটি বৌদ্ধ মঠ। এখানে যে পরিমাণ বিদেশি পর্যটক দেখা যায়, ভুটানের আর কোথাও এত পর্যটক চোখে পড়েনা। ভুটানের বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের নিকট টাইগার নেস্ট এক অতি রকম পবিত্র স্থান।

ধীরে ধীরে উপরে উঠছি

পশ্চিমা সংস্কৃতিকে ছাপিয়ে ভুটানের পোশাক, খাদ্য আর সংস্কৃতিতে তিব্বতের ছোঁয়া স্পষ্ট চোখে পড়ে। এর একটা বড় কারণ বোধহয়, তিব্বতের মতো ভুটানিরাও তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের উপাসক। কিন্তু কিভাবে এই ধর্ম এখানে এল, সেটা জানতে আপনাকে ঘড়ির কাটা পেছনে ঘুরিয়ে ফিরে যেতে হবে অতীতে। তিব্বত থেকে সন্ন্যাসী পদ্মসম্ভব এক বাঘিনীর পিঠে চড়ে সোজা এসেছিলেন পারোর এক পাহাড়ে।

কথিত আছে,পদ্মসম্ভবের অনুসারী তিব্বতের রানীই বাঘের রূপ ধরে তাকে এখানে নিয়ে আসেন। দীর্ঘ তিন বছর তিন মাস তিন দিন পাহাড়ের গুহায় তপস্যার পরে ভুটানের দুরাত্মাদের পরাস্ত করে পদ্মসম্ভব ফিরে যান তিব্বতে, আর ভুটানকে দিয়ে যান বৌদ্ধ ধর্ম। এরপর ১৬৯২ সালে তেনজিং রাবগে ওই গুহাকে ঘিরে তাকসাং নামে একটি বৌদ্ধ মঠ তৈরি করেছিলেন। ভুটানিদের বিশ্বাস, পদ্মসম্ভব ছিলেন দ্বিতীয় গৌতম বুদ্ধ আর তেনজিং রাবগেই পূর্বজন্মে ছিলেন পদ্মসম্ভব। তিব্বতি ভাষায় তাকসাং মানে বাঘের গুহা বা টাইগার নেস্ট।

ওইযে টাইগার নেস্ট

সমতল থেকে ৯০০ মিটার উচ্চতার এই মঠে পৌঁছাতে আমার সময় লেগেছে সাড়ে তিন ঘন্টা। এক পাশে খাদ আর অন্য পাশে পাহাড়ের গা ধরে উঁচু-নিচু ও সংকীর্ণ বারো কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে আমাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। আগের রাতে তুষারপাত হবার কারণে কিছু পথ খানিকটা পিচ্ছিল ছিল। তাই ঘোড়া না নিয়ে পায়ে হেঁটে চলতে গিয়ে যে ভুল করে ফেলেছি, তা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম কিচ্ছুক্ষণ পরেই। যদিও ঘোড়া নিয়ে আপনি অর্ধেকের বেশি পথ পাড়ি দিতে পারবেন না। নানা রঙের ফ্লেয়ার ফ্ল্যাগ আর সবুজ পাইনের বন আমার চোখকে তৃপ্ত করলেও, পা দুটোকে তৃপ্ত করার উপায় খুঁজে পেলামনা।  

নানা রঙের ফ্লেয়ার ফ্ল্যাগ আর সবুজ পাইনের বন 

পাইন গাছের ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করা সূর্য রশ্মি আর কিছুক্ষণ পর পর পাওয়া ঝর্ণার পানি ছাড়া শরীরকে তৃপ্ত করার একমাত্র উপায় হল যাত্রা বিরতি। গন্তব্যে পৌঁছাবার প্রায় আড়াই কিলোমিটার আগে টাইগার নেস্ট কাফেটেরিয়া যাত্রা বিরতির জন্য সবচেয়ে ভাল জায়গা। এর পরের পথটাই সবচেয়ে কঠিন। বেশ খাড়া আর সংকীর্ণ এই পথের বেশির ভাগই আমাকে পাড়ি দিতে হল পাথর কেটে বানানো সিঁড়ি ধরে। পা যখন আর এগুতে চাইছেনা, তখনই কানে আসল ঝর্ণার শব্দ। পাহাড়ের আড়ালে থাকায় এসব ঝর্ণার দেখা মেলেনা। এই ঝর্ণার সুমধুর শব্দ শুনতে শুনতে আমি পৌঁছে গেলাম মঠের একদম কাছে।  

দূরের পারো শহর

বন্ধুদের কাছে মোবাইল আর ব্যাগ রেখে টুপি খুলে মঠে প্রবেশ করলাম। কারণ মঠে মোবাইল, ক্যামেরা সাথে নিয়ে আর টুপি পরে প্রবেশ নিষেধ। উঁচু উঁচু সিঁড়ি অতিক্রম করে উপরে উঠতেই বৌদ্ধ মূর্তি, মুগ্ধ করা সব চিত্রকলা আর আগরের গন্ধমাখা নিস্তব্ধ এক আধ্যাত্মিক পরিবেশ খুঁজে পেলাম। সেখান থেকে মঠের সবচেয়ে উপরের তলায় পৌঁছে দেখা পাওয়া গেল পদ্মসম্ভবের সেই গুহার। ভেতরে উঁকি দিতেই মনে হল, সত্যই কি রহস্যেঘেরা অজানা এক পৌরাণিক নিদর্শনের সামনে বসে আছি! ভাবতে ভাবতে সেখান থেকে বের হয়ে মঠের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম; শেষ বিকেলের রোদ এসে পড়েছে সেখানে আর আমার সামনে অপুর্ব পারো শহর, এ এক বিরল সৌন্দর্য।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন