পায়ে হেঁটে ১০০ কিলোমিটার!

শাহীন কবির

ভ্রমণসংক্রান্ত পাগলামির শুরু আমার ২০০৫ সাল থেকে।  এর মধ্যে সবচেয়ে বড় পাগলামিটা করেছিলাম ২০০৭ সালে; টেকনাফ থেকে কক্সবাজার মোট ১০০ কিমি পথ হেঁটে গিয়েছিলাম সমুদ্রের পাড় ধরে। এটি সে সময় ছিল কল্পনার চেয়েও বেশী কিছু।  

মার্চের প্রথম দিকে অনলাইনে দেখলাম 'জাগো বাংলাদেশ' নামে এক প্রতিষ্ঠান বিচ হাইকিং এর আয়োজন করছে। একজন প্রাক্তন আর্মি অফিসারের নেতৃত্বে এই সংগঠন কাজ করছিল। তারা শারীরিক সক্ষমতা যাচাই করার জন্য বেশ কিছু প্রশ্ন দিয়েছিল। অনলাইনে সেসব তথ্য দিয়ে আবেদন করার পর অনেকের সঙ্গে আমার নামও এসেছিল। কক্সবাজার থেকে ঢাকার খরচ বাদে  চাঁদা দিতে হয়েছিল ৩,৫০০ টাকা।

সে সময়কার সমুদ্র তট

যাই হোক, ২০০৭ এর ২২ শে মার্চ রাতে আমি ঢাকা থেকে একা রওনা হই টেকনাফের উদ্দেশ্যে। ২৩ তারিখ সকালে শুরু হয় টেকনাফ থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে যাত্রা। নানান বয়সী নারী পুরুষ মিলিয়ে ৫০০ জন পাগল অভিযাত্রী সমুদ্র তট ধরে মন্থর পায়ে হেটে চলছে। ৫০০ লোক একই রঙের গেঞ্জি পরে ১০০ কিমি দীর্ঘ সমুদ্রের পাড় ধরে হাঁটছে। চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো দৃশ্য। 

গোটা রাস্তায় জায়গায় জায়গায় স্বেচ্ছাসেবকরা পানি আর কোমল পানীয় নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। মনে পড়ে, আমরা  ক্লান্ত হয়ে যেখানেই বিশ্রামের নেয়ার জন্য বসতাম, সমুদ্রপাড়ের মানুষ আমাদের ঘিরে ধরতো। তারা ভাবতো এই আজব চিড়িয়ারা কোথা থেকে এলো! টানা তিনদিন ধরে কূল-কিনারাহীন সমুদ্রের একই দৃশ্য দেখতে অবাক হয়ে যেতাম আর ভাবতাম সৃষ্টির বিশালতার কথা। যেখানে বড় বড় খাল পড়ত, সেখানে আমরা লোকালয়ে ঢুকে যেতাম, আবার খালের অংশ পেরিয়ে আবার বীচে নেমে আসতাম।

বিশ্রামের নেয়ার জন্য বসতাম, সমুদ্রপাড়ের মানুষ আমাদের ঘিরে ধরতো

তিনদিনে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল সমুদ্রের পাড়ে তাঁবুতে। ঢাউস সাইজের দুটি তাঁবুতে মোট ৫০০ জন।সবার জন্য সারিসারি বিছানা পাতা। একটি করে কাঁথা আর একটি করে বালিশ। তিনদিন একসাথেই থেকেছি আমরা।তিনদিনে সবাইকে মনে হত অনেক দিনের চেনা বন্ধুর মতো। আমাদের খাবার আসতো চান্দের গাড়িতে করে। পরোটা আর মুরগীর গোস্তের শুকনা পিস। অনেক সময় খাবারে বালু ঢুকে যেত। কিন্তু ক্ষুধার্ত পেটে  গোগ্রাসে ওসবই গিলতাম। তবে পানি আর ড্রিঙ্কস এর কোন অভাব ছিল না।

সবার জন্য সারিসারি বিছানা পাতা

যাত্রার প্রথমদিনেই সকালে আমি ক্যাপ হারিয়ে ফেললাম। ফলে মার্চের শেষের তীব্র গরমে আমার দুটি হাত ও মুখ পুড়ে গিয়েছিল, বড় বড় ফোস্কা পড়েছিল পায়ের নীচে। ফোস্কার জন্য শেষ ১০ কিমি হাঁটতে পারিনি।  টহলরত গাড়ি আমাকে তুলে নিয়ে এসেছিল। তাছাড়া তখন এখনকার মত এত ত্বক সুরক্ষার ক্রিমও ছিল না, ছিল না কোন সতর্কতা। হাত-পা-মুখের চামড়া উঠে অবস্থা এমন হয়েছিল যে অফিসে ফেরার পর আমাকে সহকর্মীরা দেখতে আসতো।

এই বিচ হাইকিং প্রোগ্রামের উদ্দেশ্য ছিল সারা পৃথিবীকে আমাদের ১২০ কিমি দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত সম্পর্কে জানান দেয়া। সে সময় বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমেও এটি প্রচারিত হয়েছিল। দেশীয় সংবাদ  মাধ্যমগুলো তো সরাসরি সম্প্রচার হয়েছিলো।

সবাই বাংলাদেশের পতাকা হাতে

আজ এত বছর পরে সেদিনের পাগলামির কথা মনে হলে অবাক হই।  যদিও আজকাল অনেকেই বীচ হাইকিং করে টেকনাফ থেকে কক্সবাজার পায়ে হেঁটে পৌছায়। তবে ২০০৭ সালে এমন একটি সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ ছিল না। হাটা শেষে কক্সবাজার পৌঁছার পর অদ্ভুত আনন্দের অনুভূতি হয়েছিল। সবাই বাংলাদেশের পতাকা হাতে চিৎকার করছিল। এ যেন ২৬ শে মার্চের প্রাক্কালে এক বিজয়ের মহড়া।

 

লেখকঃ শাহীন কবির, ফার্মাসিস্ট।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন