মাসুদুল হাসান রনি
দুই হাজার আট থেকে দুইহাজার আঠারো। গত দশ বছর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঘুরতে গিয়ে অনেক শহরে পা দেয়ার সুযোগ হয়েছিল। এর মধ্যে প্যারিস আমাকে বারবার হাতছানি দিয়ে ডেকেছে। আমিও সময় সুযোগ করে প্রতিবারই ছুঁটে গিয়েছি শিল্প-সাহিত্যের নগরী প্যারিসে। মোট ১৪ বার প্যারিস যাওয়া হয়েছে শুধুমাত্র ভালবাসার টানেই। প্যারিসের প্রায় সব দর্শনীয়স্থান আমার কয়েকবার করে ঘোরা। আইফেল টাওয়ার, ল্যুভর মিউজিয়াম,ভার্সাই রাজপ্রসাদ, এনভারস রাজবাড়ি, রিপাবলিক স্কোয়ার, নটরডেম চার্চ, মুজে নাসিওনাল দিস্তোয়ার নাতুরেল, পার্ক দো লা ভিলেত, এভিন্যু দ্যু শঁজেলিজে,প্যারিস গেইট,মিতেরা বিবেলথেক, লুই পাস্তুর গবেষনাগার, ইউনেস্কো সদর দপ্তর, বাস্তিল, গার্দুনর্দ, স্টেড দ্যা ফ্রান্সসহ কত দর্শনীয় এবং ইতিহাস সমৃদ্ধ স্থানে ঘুরেছি তা এখন মনেও নেই।
গত বছর ২০১৯ সালের ১৫ এপ্রিল, ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে পুড়ে গেছে নটরডেম চার্চ। সেদিন মন্ট্রিয়েলে বসে খবরটি শুনে খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল।সারাটা বিকেল মন খারাপ ছিল। মনে হচ্ছিল প্রিয়জন হারানোর বিয়োগ ব্যাথা। আমার শৈশবে পড়া ভিক্টর হুগোর ‘হাঞ্চব্যাক অভ নটরডেম’ । সেই সময় থেকে প্যারিসকে চেনা -জানা।তখনই প্রথম জেনেছিলাম নটরডেমকে। সেই নটরডেম, হুগোর তৈরি এসমেরালদা আর কোয়াসিমোদো, আমার আবেগী কৈশোর বয়সের দুই চরিত্রকে খুঁজেছি যৌবনে প্যারিসে এসে। পথে পথে খুঁজে ফিরেছি আমার দুই প্রিয় লেখক ভিক্টর হুগো, জুলভার্নের স্মৃতি। প্যারিস আমার কাছে ক্লদ মোঁনে, রেনোঁয়া ,কামিল এর যতো না, তার চাইতে বেশী ডিঁ আরতানা বা জুলভার্নের শহর।
সেই শহরে আগুনে পুড়ে গেছে নটরডেম। কি অদ্ভুত,সেদিন আমার মন বলছিল নটরডেম পুড়ছে না, পুড়ে যাচ্ছে আমার শৈশবের পড়া " হাঞ্চব্যাক অভ নটরডেম’'।১১৬০ সালে নটরডেম চার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। গোথিক স্ট্রাকচারে তৈরি, নটরডেম মূলত অন্যান্য চার্চ থেকে তার ভিন্নতা ও নতুনত্বে ভরা নির্মাণরীতির জন্য বিখ্যাত, বিশেষ করে গোথিক কাঠামোতে বাইরে থেকে সাপোর্ট দেয়া প্রবৃদ্ধি আর বেলফ্রাইগুলো।যতোবারই প্যারিস গিয়েছি ততোবারই নটরডেম বা নটরডেমের আশেপাশে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু ২০১৩ সালে শওকতভাইয়ের সাথে একবার শুধু নটরডেমই দেখতে গিয়েছিলাম।
ফ্রান্সের সবচেয়ে বিখ্যাত স্থাপনার একটি রাজধানী প্যারিসে মধ্যযুগীয় নটরডেম ক্যাথেড্রাল। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তার অনেকটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে ৮৫০ বছরের প্রাচীন এই গির্জাটি কয়েক ঘণ্টার আগুনে ক্ষতবিক্ষত হলেও এটি তৈরি করতে সময় লেগেছিল দুইশ বছর। নটরডেমের পূর্বের টাওয়ার থেকে দেখা যায় প্যারিস নগরী আর সেঁইন নদী। দূরে দেখা যায় আইফেল টাওয়ার , ফ্রেঞ্চ স্থাপত্যের বাড়িঘর। কোয়াসিমোদোর চোখে কেমন ছিলো এই শহর ? সেন্ট নিকোলাস চার্চের বিশালত্ব এখানে নাই। কিন্তু একসময় ফ্রেঞ্চ রাষ্ট্রকাঠামো আর্চবিশপ অভ প্যারিসকেই মুখ্য করে চার্চকে প্রাধান্য দিতো, ভ্যাটিকানের প্রভাব কমানোর জন্য। নটরডেম তাই ত্রয়োদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর অনেক ঘটন-অঘটন - পরিবর্তনের স্বাক্ষী।
নটরডেমের কারুকার্যময় জানালা, বিভিন্ন সন্তদের ছবি আর নানা কাহিনী খোদিত আছে জানালাগুলোতে। সূর্যের আলো যখন জানালার মাঝ দিয়ে আসে অপূর্ব সুন্দর লাগে।অলঙ্কৃত জানালাগুলো লম্বা । ভ্যাটিক্যান, প্রাগ, রোম,ব্রাসেলস, বুদাপেস্ট, পোজনান, ওয়ারশ, বন ও বার্লিনে’র আরো কিছু চার্চে গিয়েছিলাম - সেগুলো ছিল ষোড়শ শতাব্দীর। সবগুলোতে প্রায় একই ধরনের জানালা। খুবই সুন্দর কারুকার্যময়।
নটরডেমের কোয়াসিমোদোর ঘন্টা যে না শুনেছে, সে কখনো বুঝবে না তার মাধুর্য্য। আমার শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল কোয়াসিমোদোর ঘন্টা। ছুঁয়ে দেখেছিলাম, কি যে অদ্ভুত লেগেছিলো! জন্মকালা ও আধাঅন্ধ কোয়াসিমোদোর প্রিয় শব্দ ছিলো এই ঘন্টার শব্দ।
মন খারাপ করা দুপুরে দূর থেকে শুনতে পাচ্ছি নটরডেম ক্যাথেড্রালের বিশাল ঘন্টার ঢং ঢং ঢং শব্দ। প্রতিবছর শুধু নটরডাম ক্যাথেড্রাল দেখতে আসতো এক কোটি ৩০ লাখ দর্শনার্থী। সেদিন নিউজ দেখতে দেখতে বারবার মনে হয়েছে, নটরডেম পুড়ছে না,পুড়ছে বিন্দু বিন্দু করে জমা শিল্পকর্ম, ৮৫০ বছরে গড়ে উঠা কালের ইতিহাস। এই ক্যাথেড্রাল প্যারিসে দাঁড়িয়ে ছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে খুশির এবং দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় নটরডামের ঘণ্টাধ্বনি তাকে আজো স্মরনীয় করে রেখেছে। নটরডেম পুড়ে যাওয়ায় সেদিন সমগ্র ফ্রান্সবাসীর মতন আমিও ব্যথিত, মর্মাহত হয়েছিলাম।
৫.৬.২০২০
মন্ট্রিয়েল