ট্রাভেলগবিডি ডেস্ক
২০১৪ সালের ১৮ এপ্রিলের ভোর। ঘড়ির কাঁটায় তখন সাড়ে ছয়টার মতো বাজে। এভারেস্টের ক্যাম্প-২-এ পৌঁছাতে বাকি মাত্র ৪০০ মিটার পথ। এর মধ্যেই হঠাৎ বিকট শব্দে বরফখণ্ড ভেঙে পড়তে লাগল। এভারেস্টের ঢাল বেয়ে তুষারস্রোতের মতো বরফখণ্ডগুলো আমাদের দিকে ধেয়ে আসছিল। অথচ নিরাপদ কোনো আশ্রয় নেই। আমার সঙ্গে থাকা দুজন শেরপা বরফখণ্ডের স্রোতে ভেসে গেলেন, এদের একজন আমার বন্ধু আকাশ তামাং। সবই ঘটল আমার চোখের সামনে। অসহায়ের মতো দেখলাম, কিছুই করতে পারলাম না।’
বিষন্ন আর আতঙ্কিত মুখে নিউইয়র্ক টাইমসকে কথাগুলো বলছিলেন একই দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা শেরপা আবিরাল রাই। তাঁর চোখের সামনেই ১৮ এপ্রিল এভারেস্টের ঢালে ওই তুষারধসে অন্তত ১২ জন স্থানীয় শেরপা গাইড মারা যান। ১৯২১ সালে এভারেস্ট আরোহণের উদ্যোগ শুরুর পর থেকে আজ পর্যন্ত এটিকেই এভারেস্টের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা হিসেবে দেখা হয়।
তবে সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে এত বড় দুর্ঘটনায় হতাহতের তালিকায় কোনো বিদেশি নেই, সবাই স্থানীয় শেরপা গাইড। ছোট্ট একটি পরিসংখ্যানে চোখ রাখলে এর সত্যতা পাওয়া যায়। গত এক শতাব্দী ধরে এভারেস্ট জয় করতে এসে সারা বিশ্বের যে ৩০০ জন পর্বতারোহীর মৃত্যু ঘটেছে তার মধ্যে ১০০ জনের অধিক শেরপা।
শেরপারা বছরের পর বছর ধরে বিদেশি পর্বতারোহীদের গাইড হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। গাইড হিসেবে কী করতে হয় না তাঁদের! পর্বত জয়ের আশায় এভারেস্টে আসা আরোহীদের খাবার ও মালামালের বোঝা টেনে ওপরে তুলতে হয়, তাঁবু টানিয়ে আরোহীর জন্য থাকার জায়গা করতে হয়। এই কাজগুলো তাঁরা করেন রাতের আঁধারে। কারণ, দিনের আলোর তাপে বরফখণ্ড ভেঙে পড়ার আশঙ্কা থাকে। শেরপারা যখন বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে এসব কাজ করেন, তখন বেস ক্যাম্পে বসে অনুকূল আবহাওয়ার অপেক্ষায় থাকেন পর্বতারোহীরা।
প্রতি পদে মৃত্যুর ফাঁদ থাকার কথা জানার পরও শেরপারা কেন এমন কাজ করেন? এককথায় বলতে গেলে, নেপালের দরিদ্র এই নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর আসলে আর কোনো উপায় নেই। তাঁরা এতটাই প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকেন যে অর্থ উপার্জনের আর কোনো ভালো রাস্তা তাঁদের নেই। ছোটবেলা থেকে তাঁরা সুউচ্চ পর্বতারোহণে ভীষণ দক্ষ হন। বড় হয়ে সেই দক্ষতা কাজে লাগিয়ে অর্থের বিনিময়ে তাঁরা বিদেশিদের গাইড হন, এভারেস্ট জয়ে সহায়তা করেন।
পর্বতারোহীদের হয়ে কঠিন, কষ্টকর ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো করে খুব বেশি অর্থ পান না শেরপারা। নিউইয়র্ক টাইমসের ২০১৪ সালের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখা যায়, মালামাল নিয়ে প্রতিবার আরোহণের জন্য তাঁরা পেতেন ১২৫ ডলারের মতো যা বর্তমানে বেড়ে হাজারে পৌছেছে। তাই যত বেশিবার আরোহণ, তত বেশি অর্থ। কারণ এভারেস্টের আরোহনের মৌসুমে উপার্জিত অর্থ দিয়েই পরিবারের এক বছরের খরচ চালাতে হয়। তবে ২০২০ সালে করোনা মহামারির কারণে এভারেস্ট আরোহন বন্ধ রয়েছে। ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে দারুণ কষ্টে দিন পার করছেন স্থানীয় শেরপারা। তারা আশা করছেন চলতি বছর এই নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে এবং তারা আবার কাজে ফিরতে পারবে।
নেপাল ন্যাশনাল মাউন্টেইন গাইড অ্যাসোসিয়েশনের পাসাং শেরপা বলেন, শেরপারাই সব কঠিন কাজ করে থাকেন। পর্বতারোহী হয়তো বলবেন, আমি তিনবার বা চারবার এভারেস্ট জয় করেছি। তাঁরা আমাদের অতিথি, আমাদের সেটা মানতে হবে। পর্বতারোহীরা যাতে নির্বিঘ্নে এভারেস্ট জয় করতে পারেন, সে কাজ করাই আমাদের দায়িত্ব। নেপালের দিক থেকে এভারেস্ট জয়ের পথটি পর্বতারোহীদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। এভারেস্টে আরোহনের সবচেয়ে ভালো সময় মে মাস। প্রতিবছর বছর এই সময়ে এভারেস্ট জয়ে আগ্রহীরা ভিড় জমান বেস ক্যাম্পে। আর এখান থেকে তাঁদের মালামালসহ প্রয়োজনীয় জিনিস ওপরে তোলার কাজ করেন ৫০০-৬০০ জন শেরপা।
শেরপাদের যেভাবে ব্যবহার করা হয় তা নিয়ে আপত্তি প্রকাশ করেন ভারতের লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন দ্য আউটডোর-এর প্রতিষ্ঠাতা অপূর্ব প্রসাদ। তার মতে,এটি খুবই জঘন্য কাজ। একই সঙ্গে এটি অনেক পরিশ্রমের ও বিপজ্জনক কাজ। ন্যূনতম নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ছাড়াই তাঁরা পর্বতে ওঠেন। ২০১৩ সালের এপ্রিলে বিদেশি পর্বতারোহীদের নিজস্ব উদ্যোগে নিয়ে আসা গাইডদের সঙ্গে স্থানীয় শেরপা গাইডদের মারামারির ঘটনা ঘটে। কারণ শেরপারা আশঙ্কা প্রকাশ করতে থাকেন, বিদেশি গাইডদের সংখ্যা বাড়তে থাকলে তাঁদের রুটি-রুজি হুমকির মধ্যে পড়বে। এমন পরিস্থিতিতে নেপাল সরকার নিয়ম করে এভারেস্টের ২৬ হাজার ফুটের বেশি গেলেই স্থানীয় গাইডদের ভাড়া করতে হবে।
শেরপাদের ভবিষ্যৎ কী হবে বা কীভাবে এমন বিপজ্জনক কাজের সময় তাঁদের জীবনের আরও বেশি নিরাপত্তা দেওয়া যায়, এই বিষয়গুলো নিয়ে বর্তমানে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। তবে তা সময় ও চাহিদার তুলনায় অপ্রতুলই বলা চলে।
সূত্র- নিউইয়র্ক টাইমস, প্রথম আলো ও উইকিপিডিয়া