রাদিয়া তামিম
আন্দামান বা কালাপানি যাওয়ার ইচ্ছা আমার অনেকদিনের। একদিন হঠাৎ করেই সেই ইচ্ছে পূরণ হয়ে গেল। ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে এক সকালে আমার শাশুড়ি আম্মা জানালেন উনারা ডাক্তাররা সবাই মিলে একটি কনফারেন্স করতে ভারত যাচ্ছেন কিন্তু কনফারেন্স এর আগে উনারা আন্দামান ঘুরে আসবেন। আমাকেও বলল সঙ্গে যেতে। বলার সঙ্গে সঙ্গে আমি রাজি হয়ে গেলাম। আমার ভিসা করাই ছিল কিন্তু আমার দুই ছেলে স্বপ্ন সৃজনের ভিসা ছিল না। ওদের বাবা যাবেন না তাই ঠিক হলো আমি স্বপ্ন সৃজন আমার শ্বশুর শাশুড়ি আর দেবর মিলে আন্দামান যাব।
আন্দামান যেতে হলে প্রথমে কলকাতা হয়ে পোর্ট ব্লেয়ারের প্লেন ধরতে হয়। আমরা সকালে প্লেন ধরে এগারোটা নাগাদ কলকাতায় পৌঁছলাম। পোর্ট ব্লেয়ারের প্লেন দুপুর ৩টায়। এই সময়টা আমরা এয়ারপোর্টেই কাটালাম। তারপর লাঞ্চ করে পোর্ট ব্লেয়ারের প্লেন ধরলাম। তবে প্লেনে ওঠার আগে অনেক চেকিং করা হল। প্রত্যেকটা লাগেজ গ্রিন চ্যানেলে চেকিং করতে হয়। পোর্ট ব্লেয়ার পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকাল হয়ে গেল। ওখানকার ইমিগ্রেশনে একটি বিশাল ফরম ফিলাপ করতে হয়। প্রায় দু পাতার এই ফরমটি আমিসহ আরও তিনজনের ফিলাপ করতে করতে কাহিল হয়ে গেলাম। ওই ফরম জমা দেয়ার পর ইমিগ্রেশন অফিসাররা একটা রশিদ দেন ওটা আবার ফেরার সময় জমা দিতে হয়। রশিদটি হারিয়ে ফেললে অনেক ঝামেলা। এর মধ্যে আবার একটি কান্ড ঘটে গেল আমাদের গাইডকে দেখলাম খুব হয়রান হয়ে ছুটোছুটি করছে, কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতে বললেন ইমিগ্রেশন কয়েকজন ডাক্তারকে আটকে দিয়েছে। কারণ, উনাদের আন্দামান আসার পারমিশন লেটার নেই। উনারা যেহেতু সরকারি চাকরিজীবী তাই ভারতে আসার কোন ভিসা লাগে না। কিন্তু আন্দামান আসতে হলে একটা স্পেশাল পারমিশন ঢাকার ভারতীয় দূতাবাস অফিস থেকে নিতে হয়। আমাদের ট্রাভেল এজেন্সি উনাদেরকে সেটা বলেননি আর এই দিকে ইমিগ্রেশন অফিসাররা বলছেন উনারা যদি এখনই রিটার্ন ফ্লাইটে রওয়ানা দিতে না পারেন তাহলে উনাদেরকে হ্যান্ডকাপ পড়ে জেলে যেতে হবে। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে বিকেলের শেষ ফ্লাইট ছাড়তে আর ঘন্টা খানেক বাকি। আমাদের গাইড অনেক কষ্ট করে উনাদেরকে টিকেট জোগাড় করে মাদ্রাজের ফ্লাইটে তুলে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে আমাদের সেলুলার জেলের লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো এর টিকেট কাটা সন্ধ্যা ৭টা ৩০মিনিটে। আমরা তাড়াতাড়ি করে রওনা দিলাম। সেলুলার জেল, এই সেই জেল যেখানে কতশত বিপ্লবী বন্দীদের প্রাণ প্রদীপ নিভে গেছে। এই জেলের নির্মাণকাল ১৮৯৬ থেকে ১৯০৬। যদিও ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের পর থেকেই এই দ্বীপাঞ্চল নির্বাসন দেয়ার জন্য ব্যবহার হয়ে আসছিল। জেল তৈরির ইট বার্মা থেকে আনা হয়েছিল এবং এর ডিজাইনটা অনেকটা বাই সাইকেলের চাকার মতো। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে প্রতিটি কুঠুরি সমুদ্রের বিপরীতে মুখ করা যেন বন্দিরা সামনের কুঠুরির দেয়াল ছাড়া আর কিছু দেখতে না পায় ,কত বিপ্লবীর কান্না আর অত্যাচারের ইতিহাস এ দেয়ালগুলো বহন করে চলছে কে জানে। ঠিক সাড়ে সাতটা নাগাদ শো শুরু হলো। আমরা সামনের দিকে সিটে বসলাম একটি বটগাছের বয়ান থেকে এই জেলের নির্মম ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে ,খুবই মর্মান্তিক আর হৃদয় বিদারক ইতিহাস। সেলুলার জেলটি এখন মিউজিয়ামে পরিণত করা হয়েছে। আমাদের পৌঁছতে দেরি হওয়ায় মিউজিয়ামটি ঘুরে দেখতে পারিনি জেলের বাইরের চত্বরটি বেশ সুন্দর। শো শেষে হোটেলে যাওয়ার পথে শহরটা দেখলাম। বেশ পরিচ্ছন্ন শহর, আর্মি নিয়ন্ত্রিত হওয়ার আটটার মধ্যে সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। যাওয়ার পথে দেখলাম পোর্ট আলোয় ঝলমল করছে। আমরা যে রিসোর্টে ছিলাম সেটা বিচের পাড়ে ছিল রাত হয়ে যাওয়ায় বুঝতে পারিনি। ভোরে উঠে হাঁটতে হাঁটতে সামনে গিয়ে দেখলাম বিচ শান্ত পরিচ্ছন্ন। বিচে ছোট ছোট ঢেউ এসে পাড়ে আছড়ে পড়ছে। কিছুক্ষণ বিচে কাটিয়ে আমরা রওনা হয়ে গেলাম। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য হ্যাভলক দ্বীপ।
পোর্ট ব্লেয়ার থেকে হ্যাভলক দ্বীপ প্রায় দুই ঘণ্টার সমুদ্র পথের যাত্রা। আমরা সবাই আমাদের মালপত্র নিয়ে হাজির হলাম সমুদ্র জেটিতে। যেখান থেকে জাহাজ ছাড়বে। তবে তার আগে সব মালপত্র আবার চেকিং হবে আন্দামান থেকে। কোন প্রাকৃতিক জিনিস যেমন ঝিনুক শামুক প্রবাল বাইরে নেয়া যায়না তাই এই চেকিং। সব মালপত্র চেকিং শেষে আমরা গ্রিন চ্যানেল পার করে জাহাজে উঠলাম। এসি দোতলা জাহাজ সুন্দর ছিমছাম ব্যবস্থা, কিছু দোকানও আছে চা বিস্কিট বিক্রি হচ্ছে। চা বিস্কুট খেতে খেতে গল্প করতে করতে হ্যাভলক দ্বীপে পৌঁছে গেলাম তখন বেলা প্রায় একটা। আমরা একটি টুরিস্ট বাস করে রওয়ানা দিলাম। একটি ছোট বিচের পাড়ে ছিমছাম রিসোর্ট, চারিদিকে নারিকেল গাছের সারি। আমাদের রুমের সামনে ডাব গাছ থেকে দেখলাম ডাব পাড়া হচ্ছে আর আমরা সবাই মিলে বেশ মজা করে সেই ডাব খেলাম দুপুরে। বাচ্চারা বিচে দৌড়াদৌড়ি করল। পানি এতটাই স্বচ্ছ যে পানির নিচের মাছ পোকামাকড় সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে একদম ক্রিস্টাল ক্লিয়ার। লাঞ্চের সময় হওয়ায় আমরা তাড়াতাড়ি লাঞ্চ করে নিলাম। কারণ, এরপর আমরা যাব রাধানগর বিচে।
বিচটি অসম্ভব সুন্দর। সাদা বালি আর নীলাভ-সবুজ পানি সবমিলিয়ে দুর্দান্ত রাধানগর বিচ। এরমধ্যে আমার শ্বাশুড়ি আম্মার গ্রুপের ডাক্তাররা মিলে দেখলাম গান শুরু করেছে। আস্তে আস্তে সূর্য অস্ত যেতে লাগলো। কেমন একটা মন উদাস করা সময়। সূর্যটা ধীরে ধীরে সমুদ্রে হারিয়ে গেল আর আমরাও রিসোর্ট এর পথে রওয়ানা হলাম। সন্ধ্যায় দেখলাম আমাদের হোটেল রুমের সামনে বারবিকিউ এর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। মিউজিক বাজছে। কিছু তরুণ-তরুণীকে দেখলাম গল্প করছে। খাওয়া-দাওয়া করছে বেশ পার্টি পার্টি ভাব। আমরা তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়লাম। সবাই খুব ক্লান্ত। কাল আবার অনেক জার্নি করতে হবে। সকালে নাস্তা করে আমরা ব্যাগ গোছগাছ করে ফেললাম। কারণ, আমরা কালাপাথর বিচ ঘুরে পোর্ট ব্লেয়ারের উদ্দেশে রওয়ানা দেব। নাস্তা খেয়ে আমরা সবাই বিচের সামনে চেয়ারে বসলাম। খুব চমৎকার আবহাওয়া। বিচের পারে ইজি চেয়ারে বসে সামনের চমৎকার দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলাম।
কালাপাথর বিচের পানিতে নামা যায় না কারণ প্রবাল দিয়ে ঘেরা কিন্তু বিচটা খুব সুন্দর। তীব্র নীল পানি আর সাদা বালি খুবই চিত্তাকর্ষক। আমরা বেশ খানিকটা সময় কাটালাম বিচের পাড়ে। দেকানে কেনাকাটা করলাম। দোকানদারদের সাথে কথা বলে জানলাম ওদের পূর্বপুরুষ বাংলাদেশ থেকে এসেছে। কেউ নোয়াখালীর আবার কেউ বরিশাল থেকে এসেছে। দেশভাগের সময় ওরা এপারে এসে পড়ে। ভারত সরকার ওদের এইখানে জমি দিয়ে সেটেলমেন্ট করায় এখানে ভালই আছে। শুনে ভালো লাগলো।আমরা বালির উপর বসে শামুক-ঝিনুক পোকামাকড়ের কান্ড কীর্তি দেখতে লাগলাম। এখন পোর্ট ব্লেয়ার ব্লেয়ারে ফেরার পালা। পোর্ট ব্লেয়ার পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল হোটেলে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। কারণ, কাল ভোর পাঁচটায় রওনা দিতে হবে। মাত্র দুদিনে আন্দামানের কিছুই হয়তো দেখা হয়নি কিন্তু সেলুলার জেল, হ্যাভলক আইল্যান্ড এর স্মৃতি সারাটা জীবন মনের মনিকোঠায় জায়গা করে রাখবে।