চিলি আর চিজে ঠাসা ভুটানের রসনা

দিবাকর

জীবন-দর্শনে ভুটানিরা সাত্ত্বিক হলেও ভোজনে একেবারেই না। হিমালয়ের পাদদেশে নানান পদের চাল ও সবজি চাষ হওয়ায় তাদের রান্নায় রয়েছে বৈচিত্র্য। এক দেশের গালি আর অন্য দেশের বুলির মতোই ভুটানের খাদ্য রীতি। পারোতে যে খাবার খ্যাত তা হয়তো বুমতাং-এ নয়। ফুনশুলিং-এ যে ফলের আধিক্য তা কিন্তু হা-তে নয়। তবে সবকিছুর সমাহার রয়েছে রাজধানী থিম্পুর রেস্তরাঁগুলোতে। এলাকার বৈশিষ্ট্য মিলিয়ে পাওয়া যায় ফলমূল বা পানীয়। বাংলাদেশের চেংরাবান্দা হয়ে ভারতের শিলিগুড়ি দিয়ে জয়গাঁ হয়ে ভুটানের প্রবেশদ্বার ফুনশুলিং ও থিম্পু যেতে পড়বে মাইলের পর মাইল কমলা বাগান। আবার কেউ যদি বিমানপথে পারো হয়ে থিম্পু, চি লা লা পাস হয়ে হা জেলায় যান তাহলে চোখে পড়বে আপেল, আঙুর, নাশপাতি আর প্লামের বাগান। যেখানের যে ধারা। সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকজনও তাদের বাগানে তৈরি ফলমূল, জুস দিয়েই অতিথিকে আপ্যায়ন করেন। আমাদের সঙ্গে থাকা গাইড ওয়াংচুক পারো থেকে চার চার ঘণ্টার দূরত্ব পাহাড়ি পথ দিয়ে চি লা লা পাস হয়ে হা-তে গেলে স্থানীয় এক আপেল অরচার্ডে অর্থাৎ আপেল বাগানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। মালিক ভদ্রমহিলা অভ্যর্থনা জানাবার সঙ্গে সঙ্গেই গাছ থেকে দুটি করে আপেল পেড়ে খাওয়ার অনুমতি দিলেন। তবে পর্যটকরা ভুটান গেলে রেড রাইস আর মুখোরচক দাচির স্বাদ নিতে ভুল করেন না।

তা পারো বিমানবন্দর রেস্তরাঁ থেকে শুরু করে সিটি সেন্টারের সোনম ট্রাফেল, গ্যাকে পালরি, তাসি নামগে রিসোর্ট অন্যদিকে থিম্পুর থাকসিন চুং ড্রুক হোটেলে প্যারাডাইজের খাদ্য তালিকা দেখেই জানা গেছে। বাংলাদেশের শসা, মুলা বা বড় রকমের শিম সাইজ চিলি আর চিজ দিয়ে তৈরি মুখোরচক গরম গরম দাচি তিন বেলাতেই ভুটানিদের সঙ্গী। তা না হলে রেড রাইস আর এমা দাচিকে কি জাতীয় খাবারের মর্যাদা দেয়া হয়। রাজা রানির বিয়েতেও এই ছিল মেন্যু। রাজধানী থিম্পুতে জনসাধারণের উদ্দেশে দেয়া বিবাহোত্তর সংবর্ধনায় দশ হাজার অতিথিকে রেড রাইস দিয়ে তৈরি এগ ফ্রাইড রাইস আর আলোয়ার চিজে তৈরি কেওয়া দাচি দিয়ে আপ্যায়িত করা হয়েছিল।

ভুটানের অতি জনপ্রিয় রেড রাইস

৩৮ হাজার বর্গমাইলের এই দেশে সবচে জনপ্রিয় দাচি রয়েছে তিন ধরনের- এমা দাচি, কেওয়া দাচি ও শামু দাচি। চিলি আর চিজের দুর্বলতায় ঠাসা তিন পদের দাচি। ক্যাপসিকামের মতোই মনে হবে দাচিতে ব্যবহৃত বড় সাইজের চিলিগুলোকে। শুধু চিজ আর চিলিতে তৈরি দাচিকে বলা হয় এমা দাচি। আলু আর চিজে ঠাসা কেওয়া দাচি। মাশরুম আর চিজে তৈরি শামু দাচি। তিনপদের দাচি তৈরিতে টমেটো সস, লবণ, চিজ আর ইয়াকের দুধ দিয়ে তৈরি বাটার ব্যবহারই রীতি। প্রচলিত খাদ্য তালিকায় মাংসের মধ্যে রয়েছে চিকেন, মাটন, পর্ক আর ইয়াকের মাংসে তৈরি নানান পদ। 

 এমা দাচি

ভারতীয় ধাঁচে রুটি, আলু মটরের নিরামিশ, ডাল মাখানে সর্বত্র রয়েছে। মাংস ও সবজি দিয়ে তৈরি ‘পা’ একটি অতি পরিচিত খাবার। সবখানেই ভেজিটেরিয়ান আর নন ভেজিটেরিয়ান হিসাব করেই খাবার সরবরাহ করা হয়। খাদ্য তালিকায় ভেজিটেরিয়ানরা থাকেন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কারণে বাড়তি সুবিধায়। মাছে-ভাতে বাঙালিদের জন্য খানিকটা সমস্যা হবে ঠান্ডা ভুটানে। কারণ, নানা ধর্মীয় মিথ ও সংস্কারের কারণে ভুটানে মাছ ধরা হয় না। হিমালয়ে গলা পানিতে সামান্য যা কিছু মাছ ধরা পড়েও তা ভারতে রপ্তানি করা হয়। নানারকম ঠান্ডা পানীয় ভারত থেকে গেলেও সবচেয়ে সুস্বাদু মনে হয়েছে ভুটানে তৈরি আপেল জুসকে। ভুটানে সিগারেট নিষিদ্ধ হলেও রয়েছে নিজস্ব প্রক্রিয়ায় তৈরি বিয়ার ও মদ। প্রায় দোকানেই তা বিক্রি হয়। কেউ চাইলে সহজেই ত্রিশ ন্যুল থেকে শুরু এক শ’ ন্যুল দিয়ে পানীয় উপভোগ করতে পারে। ভুটানে তৈরি পানীয় আরা নামে পরিচিত। মূল খাবার পরিবেশের আগে ভুটানিরা চা খেয়ে থাকে। তেসরিংমা হারবাল টি খুবই জনপ্রিয় ভুটানিদের মধ্যে। যা লবণ ও ইয়াক মিল্ক দিয়ে পরিবেশন করা হয়। এর কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। এটি সাধারণত নিরোগ ও আয়ু বৃদ্ধিতে খেয়ে থাকে স্থানীয়রা। রয়েছে বাটার টি-ও। ইয়াকের দুধ দিয়ে তৈরি বাটার ও চিজ খুবই জনপ্রিয়। সব বাজারে বা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে এমনকি পথে-ঘাটেও ইয়াকের চিজ বিক্রি হয়ে থাকে। ইয়াক মিল্কও পানীয় হিসেবে সমাদৃত। 

নানারকমের নুডুলস যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চাউমিন নামেই পরিচিত। তীব্র সসে ঠাসা এই চাউমিন পাওয়া যাবে সবখানেই। পূর্ব ভুটানে পুতা নামে এক ধরনের নুডুলস রয়েছে, যা স্থানীয়দের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। আর রয়েছে মোমো। তা ভেজিটেবল বা চিজে অথবা চিকেন বিফে তৈরি। খুব সহজে মোমো পাওয়া যায় বেশির ভাগ রেস্তরাঁতেই। তবে পর্যটক হিসেবে ভ্রমণ ক্লান্তিজনিত ক্ষুধা নিয়ে প্রবেশ করলেই খাবার মিলবে না। অর্ডার সরবরাহের আধ ঘণ্টা বা ক্ষেত্র বিশেষে আরও অনেক বেশি সময় লাগতে পারে। এই কষ্ট সয়ে নিতেই হবে। তাড়াহুড়া করলে ভদ্রভাবে বিদায় করে দেবে। কারণ, গরম গরম খাবার পরিবেশন আর অর্ডার ছাড়া বাজার পর্যন্ত তারা করতে রাজি নয়। বাঙালিয়ানাই মিল রেখে ভুটানিদের ভোজন পর্ব শেষ করতে চাই। যদি কোন কিছুতে স্বাদ না লাগে, রুচিতে তৃপ্তি না আসে তবে লালচালের ভাত, মরিচ পিয়াজে ডিমের অমলেট আর ঘন ডালতো রইলই। ইয়াকের দুধে তৈরি শরবতি চায়ের বদলা লাল চা পাওয়া যায় সর্বত্রই।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন