দিবাকর ‘বাসাবাড়ি কোথাও নেই/ তাই তাঁবু পাতলেম নদীর ধারে সঙ্গী ছিল না কেউ,/ কেবল ছিল সেই ক্যামেলিয়া।’ কবিতার লাইনগুলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঞ্চয়িতা ‘কাব্যগ্রন্থ’ থেকে নেয়া। কবি এটি লিখেছিলেন গাছপাগল জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর তৈরি বলধা গার্ডেনে বসেই। জয় হাউসে। এমন নানা বিচিত্র বৃক্ষরাজির সমাহার করেছিলেন নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী। আর এই স্থানটি ঢাকার একসময়ের অভিজাত এলাকা বলে পরিচিত ওয়ারীতে অবস্থিত। ইতিহাসের কথায় পরে আসি। আগে বলে নিই এই ঢাকায় যে কটি স্থাপনা মানুষের মনে দাগ কেটেছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বলধা গার্ডেনে। ঘিঞ্জি এই ঢাকার ফুসফুস বলে কিছু থাকলে তাও এই বলধা গার্ডেনই। কারণ পুরোনো ঢাকায় এত বেশি গাছের সমাহার আর কোথাও নেই। এবার ফিরি এর ইতিহাসে।
১৯০৯ সালে কাজ শুরু করে শেষ হয়েছিল ঠিক তার ২৭ বছর পর ১৯৩৬ সালে। অথচ জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী ছিলেন না স্থপতি না উদ্ভিদবিজ্ঞানী। অথচ তিনিই গড়ে তুলেছিলেন উপমহাদেশের সেরা উদ্ভিদ বাগান। তিনি ছিলেন গাজীপুরের বলধা গ্রামের শেষ জমিদার। জন্মেছিলেন ১৮৮০ সালে গাছার জমিদার মহিম চন্দ্রের ঘরে। তার বয়স যখন ১৪ তখন নিঃসন্তান বলধার জমিদার তাকে দত্তক নেন। বলধার বাইরে দার্জিলিং, কলকাতা, লক্ষ্ণৌ , পুরী ও ঢাকার ওয়ারীতে বাড়ি তৈরি করেন তিনি। ওয়ারীর বাড়িটির নাম ছিল ‘কালচার হাউস’। পরে এই কালচার হাউস ধীরে ধীরে বলধা হাউস নামে পরিচিত লাভ করে। সাইকি ও সিবিলি মিলিয়ে বাগানে ৮৭ পরিবারের ৭২০ প্রজাতির প্রায় পঁচিশ হাজার উদ্ভিদ রয়েছে বলধা গার্ডেনে। নাম লিখে শেষ করা যাবে না। জ্যাকুইনিয়া, শারদমল্লিকা, কণ্ঠকলতা, গুস্তাভা, শ্বেতচন্দন, সাইকাস, স্বর্ণ অশোক, কুর্চি, ভুজপত্র, লতাবট, লতাচালতা, ক্যানেঙ্গা, নবমল্লিকা, ওলিওপ্রেগরেন্স, র্যাভেনিয়া, আফ্রিকান বকুল, নাগলিঙ্গম, উদয়পদ্ম, রাজ অশোক, অ্যারোপয়জন, আফ্রিকান বকুল, লতা জবা, স্কারলেট, কপসিয়া, হলুদ, দেবকাঞ্চন, কনকসুধা, কনকচাঁপা, জিঙ্গো বাইলোবা, গড়শিঙ্গা, মাধবী, পান্থপাদপ, ঘৃতকুমারি, তুড়কচন্ডাল, শতায়ু উদ্ভিদ, রুদ্র পলাশ, আমাজন লিলি, পিয়াল, পাখিফুল, কৃষ্ণবট আরও কতো কি। তাছাড়া নানা রকমের লতা জাতীয় ও জলজ উদ্ভিদ, ঔষধি বৃক্ষ তো রয়েছেই।
যেভাবে শুরু বলধা গার্ডেনের ১৯০৯ সালে ৩৬ শতাংশ অর্থাৎ ৩.৩৮ একর জমির ওপর শুরু করেন বলধা গার্ডেনের সাইকি অংশের কাজ। এটি শেষ হয় ১৯৩৬ সালে। ১৯৩৮ সালে শুরু করেন বাগানের উত্তর অংশ সিবিলির কাজ। এই অংশের কাজ শেষ হয় ১৯৪৩ সালে। দেশ-বিদেশের নানা প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদ দিয়ে ধীরে ধীরে পূর্ণতা পায় ‘বলধা গার্ডেনের সাইকি ও সিবিলি অংশ। গ্রিক শব্দ সিবিলি অর্থ প্রকৃতি এবং সাইকি অর্থ আত্মা। নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় পূর্ণতা পায় বলধা গার্ডেন। কাজ শেষ করার পর পরই অর্থাৎ ১৯৪৩ সালের ১৩ আগস্ট তার মৃত্যু হয়। বিভিন্ন ধরনের অর্কিড, ক্যাকটাস, জলজ উদ্ভিদ সহ বলধা গার্ডেনে যে গাছপালা আছে তা শুধু এদেশের জন্যই বিরল সম্পদ নয়, বিশ্বের উদ্ভিদ বিশারদদের কাছেও অনেকটা বিরল সম্পদ। উদ্যানে আছে প্রায় ২৫ হাজার উদ্ভিদ, প্রজাতির সংখ্যা ৭২০টি। পৃথিবীর প্রায় ৫০টি দেশের দু®প্রাপ্য ও মূল্যবান গাছ আছে এখানে। এক সময় গোলাপের বাগানে ছিল প্রায় ২০০ জাতের গোলাপ। এর অধিকাংশই এখন বিলুপ্ত। অর্কিড হাউসে প্রায় ২০০ জাতের অর্কিড আছে। বলধা গার্ডেনকে বৃক্ষ, জলাশয়, অর্কিড হাউস ও অন্যান্য উদ্ভিদ কর্নার ইত্যাদি মিলে এক অপূর্ব উদ্যান বলা চলে।
নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর সঙ্গে সহযোগিতায় ছিলেন আর এক প্রকৃতিপ্রেমী অমৃত আচার্য। ১৯৪৩ সালের পর ম্লান হয়ে আসে এ উদ্যান। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর বাগানের অবক্ষয় অব্যাহত থাকে। এ বাগানকে রক্ষা করার জন্য ১৯৫১ সালে কোর্ট অব ওয়ার্ডস ও ১৯৬২ সালে বন বিভাগের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। বর্তমানে তা চলছে লিজের মাধ্যমে। পাঁচ টাকা টিকিটে যে কেউ বেড়াতে যেতে পারেন বলধা গার্ডেন। এক সময় এখানেই মেলা বসতো ঢাকার অভিজাতদের। হতো নাটক আর গানের আসর। নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী নিজেও ছিলেন নাট্যকার। আজ তার স্মৃতিবহ শতবর্ষী এই গার্ডেন ঢাকাবাসীর গৌরবের অংশ হয়ে টিকে আছে।
সময়সূচি: ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা এবং মার্চ থেকে নভেম্বর প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। ১২ টা থেকে ২ পর্যন্ত মধ্যাহ্ন বিরতীর জন্য বন্ধ থাকে।
প্রবেশ মূল্য: প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ১০ টাকা শুভেচ্ছামূল্য রাখা হয়। তবে শিক্ষার্থী এবং গবেষণায় কাজে প্রবেশে ৫ টাকা হয়। অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ৪ টাকা।
যাওয়ার উপায়: রাজধানীর যেকোন জায়গা থেকে গুলিস্থানে নেমে রিকাশায় করে যাওয়া যায়। আবার হেটেও আসতে পারেন। তবে যাত্রবাড়ী থেকে ট্রান্সসিলভা, ৮ নাম্বার, বোরাক ইত্যাদি বাসে করে আসলে বলধা গার্ডেনের সামনে নামিয়ে দেয়।