খালি পকেটে বিশ্ব ভ্রমণ

এস এন জিকু

পিটার। পুরো নাম ফিউদায় মিরাভিনিচেজ পিটার। বাড়ি মধ্য ইউরোপের দেশ চেক রিপাবলিকের রাজধানী প্রাগ থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে জেচিন নামের একটি ছোট্ট শহরে। পিটারের সাথে আমার দেখা হয়েছে একেবারে অপ্রত্যাশিত ভাবে। রামুতে আমাদের একটি রেস্টুরেন্ট আছে। সেই রেস্টুরেন্টে সন্ধ্যার দিকে আমি বসে আছি, হঠাৎ বাইরে দেখলাম একজন বিদেশী কি যেন খুঁজছে। একজন ওয়েটার গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন আপনি কি চান? পিটার ইংরেজিতে বলল যার বাংলা অনুবাদ অনেকটা এরকম,ভাত এবং ভাতের সাথে মুরগির মাংস অথবা গরুর মাংস হবে? ওয়েটার সম্পুর্ণ বুঝতে পারলো না। আমি গিয়ে বললাম আছে আপনি বসুন নিজ দেশে পিটার। ছবি-ফেসবুক[/caption] এরপর পিটারকে খাবার পরিবেশন করা হল। দেখলাম পিটার বেশ কষ্ট করে চামচ দিয়ে খাচ্ছে। লক্ষ্য করে বুঝলাম সে বেশ ক্লান্ত। প্রথম দেখায় আমি ভেবেছিলাম পিটার হয়তো ক্রিকেট কোচ, আশেপাশে কোথাও প্র্যাকটিস করায়। কিন্তু আমার কেন যেন জিজ্ঞেস করতে মন চাইল-পিটার কোথা থেকে এসেছে? কি করে ? ইত্যাদি। আমি অপেক্ষা করছিলাম পিটারের খাওয়া কখন শেষ হবে। কিছুক্ষণ পরে পিটারের খাওয়া শেষ হল। শেষ করেই মোবাইলে কি যেন বলা শুরু করলো। সম্ভবত কারো সাথে হয়তো হোয়াটস অ্যাপে কথা বলছে।

পিটার

বিশ্বের এমন অজানা সব জায়গায় ঘুরে বেড়ায় সে। কথা বলা শেষ হলে আলাপ শুরু করলাম। কথা বলে যা জানলাম তা আমার ভিমরি খাওয়ার জন্য যথেষ্ট। পিটার একজন সোলো ট্রাভেলার। একাই সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ায়। ইতোমধ্যে ৫৮ টি দেশ সফলভাবে ভ্রমণ করেছেন। সম্প্রতি ভারত ঘুরে বাংলাদেশে এসেছেন। আমার আগ্রহ বেড়ে গেল। আমার আগ্রহ দেখে পিটারও তার অভিজ্ঞতার ঝাঁপি খুলে দিল। পিটার ভ্রমণের সময় হোটেলে উঠেন না। আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। পরে তিনি বললেন তিনি সত্যিই হোটেলে উঠেন না। যেখানে রাত হয় তিনি সেখানেই ক্যাম্প করে থাকেন। বন জঙ্গলে, রাস্তার ধারে, স্টেশনের পাশে বা বাসাবাড়ির ছাদে অথবা খোলা মাঠে। এজন্য তিনি সঙ্গে সব ধরনের প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো ব্যাকপ্যাকে বহন করে সঙ্গে নিয়ে চলেন। ব্যাকপ্যাকের ওজন প্রায় ১৫ কেজি। বাকখালী নদীর তীরে। ভ্রমণের সময় তিনি কোন ধরনের ট্যাক্সি, ট্রেন বা বাস ব্যবহার করেন না। রাস্তার পাশে দাঁড়ান এবং ট্রাক থেকে লিফট নেন। এভাবে তিনি অধিকাংশ দেশ ভ্রমণ করেন। আমার তখনও বিশ্বাস হয়নি। পরে আমার আমি বিশ্বাস করতে বাধ্য হই। কারণ আমি পিটারকে নিয়ে রামুর প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির দেখতে যাই। মন্দির দেখা শেষ করে বাকখালী নদীর পাশ ধরে হেঁটে হেঁটে নাইক্ষ্যংছড়ি রোডে উঠি। সেখান থেকে রামু চা-বাগানের দুরত্ব প্রায় ২ কিলোমিটার। আমি পিটারকে বললাম চল আমরা টমটম বা অটো নিই। পিটারের চোখে একটা না না ভাব লক্ষ করলাম। কিন্তু আমি আশ্বস্ত করলাম যে ভাড়া আমি দিবো। তবে কোন গাড়ি না পেয়ে আমরা হাটা শুরু করলাম।

পিটার ও তার ব্যাগ 

হেঁটে কিছুটা আসার পর দেখলাম একটা মিনি ট্রাক আসছে। পিটার সেই ট্রাকটাকে ইশারা করে সিগনাল দিল। দিব্যি ট্রাকটা দাঁড়াল। আমি তখনও পিছনে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। দুজনেই উঠে পড়লাম ট্রাকে। মাঝ পথে এসে পিটার একটা মুচকি হাসি দিয়ে আমাকে বলল ‘ This is how I travel (আমি এভাবেই ভ্রমণ করি)। আমি কোন উত্তর দিলাম না। সত্যি বলতে কি আমি তখন এক প্রকার লজ্জায় পড়ে গেলাম! ট্রাকে ওঠার পর পিটার জানালো, খাবার শেষ করে সে হোয়াটস অ্যাপে কারো সঙ্গে কথা বলছিলো না। তার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা মোবাইলে রেকর্ড করছিল। কোন নতুন এলাকায় ভ্রমণ করে অভিজ্ঞতা লেখার পরিবর্তে ফোনে রেকর্ড করে রাখে। তার মতে রেকর্ড করাটা লেখার চেয়ে সুবিধাজনক। এতে সময় বাঁচে।

পিটারকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম তার কাছে বাংলাদেশী সিম কার্ড আছে কিনা। পিটার নির্দ্বিধায় জানালো, তার কাছে সিম কার্ড বা ইন্টারনেট কেনার মতো যথেষ্ট টাকা নেই। সে সপ্তাহে এক বা দুইবার ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্কে সাথে সংযুক্ত হয়। পিটার সঙ্গে যত কথা বলছি আমার আগ্রহের মাত্রা ততই বাড়ছে। আমি একের পর এক প্রশ্ন করছি আর পিটার তার উত্তর দিচ্ছে। প্রশ্নের ছলে বললাম, আচ্ছা পিটার বুঝলাম তোমার না হয় থাকতে হোটেল লাগে না বা যাতায়াতের জন্য বাস বা ট্যাক্সি লাগে না। কিন্তু তুমি খাওয়ার বা ভিসার জন্য টাকা পাও কিভাবে?

রামুতে

পিটার অকপটে উত্তর দিলেন তিনি বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে সেই দেশের ঐতিহাসিক স্থানগুলোর ছবি তুলে চীন, কোরিয়া বা মালয়েশিয়া অথবা অন্য দেশে বিক্রি করে। ভ্রমণের আনুষাঙ্গিক খরচ গুলো এইভাবেই মেটায়। পিটারকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম তুমি যে রাতে খোলা মাঠে থাকবে তোমার কি পর্যাপ্ত গরম কাপড় আছে? পিটার বলল, আছে কিছু তবে বিষয় কি জানো? তোমাদের দেশে উইন্টারে যেরকম শীত পড়ে আমাদের দেশে সামারে এর চেয়ে বেশি শীত পড়ে!

এই সব ছবি বিক্রয় করেই ভ্রমণের খরচ চলে। ছবি-ফেসবুক[/caption] আমরা অনেকেই মনে করি ভ্রমণের জন্য কাড়ি কাড়ি টাকা লাগে। কিন্তু পিটার আমার এই ধারণায় ধাক্কা দিয়েছেন। তিনি বুঝিয়েছেন ভ্রমণের জন্য টাকার চেয়ে ইচ্ছা শক্তিই বড় নিয়ামক। অজানাকে জানার ইচ্ছাই আপনাকে ঘর ছাড়তে বাধ্য করবে। তাই কেউ যদি দেশে-বিদেশে নতুন নতুন স্থান ভ্রমণ করার স্বপ্ন বুকে লালন করেন তাহলে সেই স্বপ্নকে লালন না করে বাস্তবে পরিণত করার চেষ্টা করুণ। অবশ্যই সে চেষ্টা সফল হবে।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন