বেনজীর আহমেদ সিদ্দিকী
বাতাসে পাকা ধানের অন্য রকম সুবাস। রাস্তার পাশ দিয়ে কিছুটা দূরত্ব নিয়ে সারি সারি পামগাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পামগাছে বাসা বেঁধেছে ছোট ছোট বাবুই, দাগি বাউরি পাখি। ওদের সারাক্ষণের ব্যস্ততা ও লুটোপুটি আসলেই দেখার মতো এক দৃশ্য। এর মাঝেই আশপাশ থেকে নাকে এসে লাগে বুনো ফুলের মিষ্টি সুঘ্রাণ। মুগ্ধতা ছড়ানো সজীব বাতাসে চোখ জুড়িয়ে নিয়ে পথের দিকে তাকালে কিছুক্ষণ পরপর দেখা যায় মহিষের গাড়িগুলো হেলেদুলে মাঠ থেকে কাটা ধান ও অন্যান্য শস্য নিয়ে ফিরছে। এ যেন চিরন্তন কম্বোডিয়ার মফস্বল ও গ্রামের নিত্যকার চিত্র। এমন অসাধারণ দৃশ্যগুলো সাথি করে হাজির হলাম নমপেনের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের মফস্বল শহর ক্যাম্পটে। এই মফস্বল শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সুন্দর একটা আঁকাবাঁকা নদী। মজার বিষয় হলো, এ শহর সেই প্রাচীনকাল থেকে গোলমরিচ উৎপাদন ও রপ্তানির জন্য বেশ নামকরা। তবে এর আশপাশের গ্রামগুলোতে প্রচুর ধান উৎপন্ন হয়।
যাহোক, কম্বোডিয়ার বন্ধু ট্যান ইউয়াং তার মোটরবাইকে বসিয়ে আমাকে নিয়ে চলল ক্যাম্পটের প্রাদেশিক জাদুঘরে, যা আগে গভর্নরের বাড়ি ছিল। পুরো জাদুঘর ঘুরে মনে হলো, প্রাচীন নমপেন ও ক্যাম্পট যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। রয়েছে এখানে উৎপন্ন হওয়া বিভিন্ন মসলা, বিশেষ করে গোলমরিচের নানান বিষয়ের প্রদর্শনী।
জাদুঘর দেখা শেষ করে বন্ধুর সঙ্গে ছুটলাম ট্যুয়েক চু নদীতে। নদীর বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে নিয়ে দেখতে লাগলাম এক পাশের ভাসমান নৌকার বাজার। জীবন যেন সেখানে নানান পসরা সাজিয়ে বসেছে। বিকিকিনি চলছে হরদম, এর মাঝেই চোখে পড়ল কেউবা নদীতে সাঁতার কাটছে আবার কেউ প্যাডেল দেওয়া নৌকা চালাচ্ছে। এসব দেখতে দেখতে পেটে ক্ষুধার ইঁদুর ততক্ষণে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছে।
বন্ধু মনে হয় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছিল, তাই সে আমাকে নিয়ে চলল ক্যাম্পট ক্যানারি ইয়েলো ফিশ মার্কেটে, যেটা আসলে নানাবিধ সামুদ্রিক মাছের ভীষণ সুন্দর রেস্তোরাঁ। ভেতরে প্রবেশ করতেই জীবন্ত নানা সামুদ্রিক মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়ার সমাহার মন কেড়ে নিল। দুজন মিলে নারকেল দিয়ে গ্রেভি করা বেশ বড়সড় ছয়টা চিংড়ি ও কাঁকড়া খেয়ে খানিকক্ষণ আড্ডা দিয়ে উঠে পড়লাম, উদ্দেশ্য বন্ধুর বাড়ি। সেখানে তার কথামতো নাকি অসাধারণ একটা সারপ্রাইজ আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
বন্ধুর মোটরবাইকে চড়ে চারপাশের মানুষের ব্যস্ত জীবন, টুকটুক (একধরনের অটোরিকশা), গাড়িকে পাশ কাটিয়ে বাড়িতে এসে উপস্থিত হলাম। মোটরবাইক থেকে নেমে চোখ ছানাবড়া। ছবির মতো সুন্দর পরিপাটি ও পরিচ্ছন্ন বাড়ি! ঘরে প্রবেশের আগে নকশা করা মটকার মাঝে বেশ বড়সড় ফুলের গাছ। ফুল গাছ দেখতে অনেকটা চেরি ফুল গাছের মতো। তবে দেখতে সুন্দর হলেও কোনো গন্ধ নেই। বাড়ির দেয়ালজুড়ে বিভিন্ন দৃশ্যসংবলিত পেইন্টিং। বাড়িতে পা ফেলে আরও অবাক হলাম যখন জানতে পারলাম, আমার আসা উপলক্ষে কম্বোডিয়ার ঐতিহ্যবাহী পিঠা বানানো হবে।
শেষ দুপুরের দিকে বন্ধুর বড় বোনের নেতৃত্বে বাড়ির মেয়েরা পিঠা বানানোর এলাহি কারবার শুরু করে দিল। লম্বা লম্বা কলাপাতা ধুয়ে নিয়ে আসা হলো। শুকানোর পর কিছু পাতা কেটে কেটে ছোট করা হলো। ততক্ষণে পাশের কাঠের চুলায় বড় সসপ্যানে পানি গরম করতে দেওয়া হয়ে গেছে। মেয়েরা সুগন্ধি চাল, কলা, নারকেল, চিনি, গুড়, স্থানীয় মসলা দিয়ে একটা মিশ্রণ তৈরি করে হাত দিয়ে মিশিয়ে একটা স্তরে সাজিয়ে কলাপাতায় মুড়ে রাখছে।
এসব দেখতে দেখতে বন্ধুর বড় বোন এনগে ঝ্যাংয়ের কাছে জানতে চাইলাম কম্বোডিয়ার পিঠা নিয়ে। তিনি জানালেন, কম্বোডিয়ায় বিভিন্ন উপলক্ষে ঐতিহ্যবাহী কিছু পিঠা তৈরি করা হয়। এর মাঝে নুম কম ও নুম আনসোম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নুম কম একটি আঠালো চালের আবরণ দেওয়া কলা, নারকেল ও খেজুরের গুড় বা চিনির পুর দিয়ে তৈরি পিঠা। এই পিঠাকে কলার পাতায় মুড়িয়ে বাষ্পে রাখা হয়। এরপর নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সেদ্ধ হয়ে এলে নানা রকম মিষ্টি সিরাপে ডুবিয়ে এই স্টিকি বা আঠালো পিঠা খাওয়া হয়।
তিনি আরও যোগ করলেন, ঐতিহ্যগতভাবে নুম আনসোম বা খেমের স্টিকি রাইস কেক একটি প্রচলিত পিঠা, যা কম্বোডিয়ানরা খেমের নতুন বছর বা পাচুম বেন ডের (পূর্বপুরুষ দিবস) মতো বছরের বড় উৎসবগুলোতে তৈরি করে। এ সময়ের মধ্যে কম্বোডিয়ার গ্রাম বা মফস্বলের বেশির ভাগ পরিবার সন্ন্যাসী এবং তাদের পূর্বপুরুষদের কাছে উপহার হিসেবে নুম আনসোমকে সমর্পণ করবে। সেই সঙ্গে শহর থেকে বেড়াতে আসা আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধবের জন্য এটি একটি বিশেষ উপহার হিসেবে বিবেচিত হবে।
নুম আনসোম হলো প্রাণী বা পাখির মাংস এবং মুগডালের পুর দিয়ে বানানো চালের পিঠা। নুম কমের মতোই এই পিঠাকেও কলাপাতায় মুড়ে সুতা বা কলাগাছের দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। এরপর এটিকে বাষ্পায়ন করে বা ভেজে ফিশ সস এবং আচারযুক্ত শাকসবজি দিয়ে পরিবেশন করা হয়। এনগে ঝ্যাং বললেন, একসময় কম্বোডিয়ায় অনেক হিন্দু ও মন্দির ছিল। সেই সময়ের সংস্কৃতি থেকেই নাকি নুম কম এবং নুম আনসোম এসেছে। বিশেষ করে শিবের উপাসনার সঙ্গে নাকি এর সম্পর্ক রয়েছে। কম্বোডিয়ার অধিকাংশ মানুষ মূলত বৌদ্ধধর্মের অনুসারী হলেও এখনো তাদের জীবন ও আচারে হিন্দুধর্মীয় নানান বিষয় খুঁজে পাওয়া যায়।
গল্প করতে করতে বিকেল হয়ে এল, ওদিকে অনেকগুলো পিঠা গরম সসপ্যানের বাষ্প থেকে তুলে এনে বেশ সুন্দর করে পরিবেশন করা হলো আমার সামনে। বন্ধুর পরিবারের সঙ্গে বসে বিভিন্ন গল্প করছি আর সুগন্ধযুক্ত পিঠা খাচ্ছি। কম্বোডিয়ার ঐতিহ্যের বাতাস মুখে এসে লাগছে। সবাই মিলে গোল হয়ে বসে পিঠা খাওয়া, হাসিঠাট্টা করা যেন কম্বোডিয়ার চিরায়ত সুখী পারিবারিক মধ্যবিত্ত জীবনকেই মনে করিয়ে দিল।
সূত্র-প্রথম আলো