কনি, বিশ্ব শান্তির শ্বেত পায়রা

মাসুদুল হাসান রনি

 

সুমনের ছুটি মিলছিল না বলে লংড্রাইভ কিংবা উইকএন্ডে কোথাও যাওয়া হচ্ছিল না। ভোরবেলা বের হয়ে সে সন্ধ্যার ঠিক আগে বাসায় ফিরতো। লম্বা শাওয়ার নিয়ে ক্লান্ত শরীর সতেজ চনমনে করে আমাকে নিয়ে বের হতো। রাতের নিউইয়র্ক সিটি, ম্যানহাটন ঘোরাফেরা শেষে নিয়ে যেত কোন দামী রেস্তোরাঁয়।আমার নিউইয়র্কবাসের প্রায় পুরো সময়টা ছিলাম উডহ্যাভেন বুলভার্ডে সুমনের  বাসায়। প্রায় প্রতিদিন আমাদের মানে আমি, সুমন ও তার কাজিন আবিরের রাতের ডিনার হতো রেস্তোরাঁয়। সুমন তখন ম্যানহাটনে ফেডারেল রির্জাভ ব্যাংকে জব করে। আবার সাপ্তাহের ছুটিরদিন তার আইটি ফার্মে সময় দেয়। মহাব্যস্থতায় তার দিন কাটে।

হঠাৎ করেই অক্টোবরের প্রথম সাপ্তাহে  কিসের যেন লম্বা ছুটি পেয়ে যায়। ছুটি শুরুর দুদিন আগে আমরা বাসায় প্রজেক্টরে সিনেমা দেখতে দেখতে প্ল্যান করি কোথায় কোথায় যাওয়া যায়।আমেরিকায় এসেছি ওয়াশিংটন যাবো না, হোয়াইট হাউজ দেখা হবে না, এটা কি হয়! সুমনও চাইছিল দূরে কোথাও ঘুরতে যাবে। আমাদের ভাবনা মিলে যায়, আমরা ওয়াশিংটন যাচ্ছি। ছুটির ভোরে ম্যানহাটন থেকে আমরা তিনজন গ্রে হাউন্ড বাস চেপে রওয়ানা দেই ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্যে। দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে যাই বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশের রাজধানী ওয়াশিংটন।

লেখক ও তার বন্ধুরা

বাস থেকে নামতেই ক্ষুধায় পেটে যেন আগুন লেগে যায়। ক্ষুধা নিবৃত্ত করতে চায়না টাউনের পাশে একটা মেক্সিকান রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়ি। নানান পদের খাবারের অর্ডারের সাথে সুমন অক্টোপাস অর্ডার করে। প্রথমবার অক্টোপাস খেতে খারাপ লাগেনি। যদিও শুরুতে নাম শুনে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। ওয়াক, অক্টোপাস মানুষ খায়! আমার গা গুলানো দেখে সুমন ও আবির হাসে। আমি বারবার বলি, এটা আমার জন্য অর্ডার করো না।

সুমন এবার কঠিন কন্ঠে বলে, আপনাকে খেতেই হবে। এটা খেলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হবে? মিয়া ফাজলামো রেখে চুপচাপ খেয়ে দেখেন। আর  অর্ডার ক্যান্সেল করা যাবে না।আমি মিনমিনে গলায় কিছু বলতে গিয়ে পারি না। তার আগেই খাবার টেবিলে চলে এসেছে। আমি নাক ও কপাল কুঁচকে প্লেটে অক্টোপাস খুঁজি। তার পরিবর্তে দেখি সাদা বেশনে চিপসের মতন কি যেন প্লেট ভর্তি। সাথে ঝাল সস। এটা যে অক্টোপাস নয় ভেবে মুখে দিয়ে বুঝতে পারি মাংস জাতীয় কিছু একটা খাচ্ছি। সস মেখে টপাটপ দু'চারটে খেতেই সুমন জিগেস করে, কেমন ইয়াম্মি না? আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দেই। খুব সুস্বাদু। এবার সুমন ভারিক্কি কন্ঠে বলল,খাওয়ার আগে এতো ভুংভাং কেন করলেন?  এটা অক্টোপাস। হায় হায়, বলে কি! খাওয়ার সময় একদমই মনে হয়নি আমি অক্টোপাস খাচ্ছি।

রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে ক্যাপিটাল হিল, কংগ্রেস ভবন, চায়না টাউন ঘুরে চলে যাই প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন,  মার্টিন লুথার কিং মেমোরিয়াল, কংগ্রস ভবন ও ক্যাপিটোল হিল দেখতে। ঘন্টা খানেক ঘুরে আমরা আসি প্রথম ও দ্বিতীয়  বিশ্বযুদ্ধে নিহত আমেরিকান সৈনিকদের স্মৃতিস্তম্ভ দেখার জন্য। সেইসব স্থান নিয়ে আলাদা করে লিখব স্মৃতি কথা।বিকেলের মোলায়েম রোদ গায়ে মেখে হেঁটে হেঁটে ওয়াশিংটনের পথ ঘাট ঘুরতে খারাপ লাগেনি।কিছুটা ক্লান্তি থাকলেও নতুন কিছু দেখার আশায় এসব ক্লান্তিটান্তি পাত্তা পায়নি। বেলা ৪টায় আমরা ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে আসি  বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর প্রেসিডেন্টের অফিসিয়াল বাসভবন হোয়াইট হাউজের সামনে । আহা কি সুন্দর সাদা রঙের ভবন! পাশেই ওভাল হাউজ, প্রেসিডেন্টের দাপ্তরিক অফিস। কিছুটা সময় অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি। প্রচুর দর্শনার্থীদের ভীড়। সবাই wow, white house!  বলেই চিৎকার, হৈ হুল্লোড় করছে,ছবি তুলছে।অবাক লাগলো কোথাও কোন সিকিউরিটির বাড়াবাড়ি না দেখে।মনে হলো, দু'চারজন সিকিউরিটি ব্যারিকেডের সামনে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে দর্শনার্থীদের আনন্দ উপভোগই করলো। আমরাও শিশু কিশোরদের মতন আনন্দ উল্লাস করে প্রচুর ছবি তুলি। হোয়াইট হাউজের লন বা গার্ডেন সবুজে মোড়ানো।পরম যত্ন ও পরিচর্যায় কিছু ফুলের গাছ বাগানের সৌন্দর্য বর্ধন করেছে ,  অনেক নাম না জানা ফুল ফুটে আছে।

হোয়াইট হাউজের সামনে লেখক

হোয়াইট হাউজের সামনে কিছু সময় কাটিয়ে রাস্তা পেরিয়ে আসার পর বিরাট বিস্ময়ের মুখোমুখি হলাম। এক বৃদ্ধা নারী তাবু খাটিয়ে যুদ্ধ,পারমানবিক অস্ত্র ও ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শান্তির পক্ষে প্লাকার্ড, ব্যানার নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে অবস্থান করছেন। বিস্মিত হলাম এই কারনে যে, হোয়াইট হাউসের নাকের ডগায় এরকম প্রতিবাদ হচ্ছে দেখে।  অথচ আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে এ ঘটনা ঘটলে কি তুলকালাম কান্ডই না করতো পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের পেটোয়া বাহিনী!

বৃদ্ধার বেশ কিছু ছবি তুলি। দুর্ভাগ্য আমার ছবিটি আবিরকে দিয়ে তুলেছিলাম। বাসায় ফিরে দেখি ছবিটি সে তুলতে পারেনি। শান্তিবাদী এই নারীর সাথে ছবি তুলতে না পারার বেদনা আজো আমাকে পীড়িত করে। আমার তোলা দুনিয়া কাঁপানো বৃদ্ধার চারটে ছবি আজো আছে। স্পেনিশ আমেরিকান এই শান্তিবাদী নারীর নাম কনচিতা বা কনি।  তার আসল নাম (Concepcion Picciotto) কনসেপসিওন পিক্কিওট্টো। তিনি ১৯৮১ সাল থেকে হোয়াইট হাউজের সামনে একই স্থানে তাবু গেড়ে শান্তির পক্ষে একাই লড়ে গেছেন। টানা ৩২ বছর ধরে প্রতিদিন প্রতিবাদ করেছেন। এখানে ঘুরতে আসা বিভিন্ন দেশের মানুষ যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্ব শান্তির পক্ষে তার সাথে একাত্মতা ও সংহতি প্রকাশ করেছেন।

বিশ্ব শান্তির শ্বেত পায়রা

কনি হোয়াইট হাউসের ঠিক বিপরীতে রাস্তার এপাড়ে ফুটপাত ঘেষা পার্কে একটি ভারি পলিথিনের তাবু বানিয়ে থাকতেন। অনেকটাই হোমলেসদের মতন। ২০১৬ সালের ২৫ জানুয়ারি এই শান্তিবাদী নারী  বার্ধক্যজনিত কারনে মৃত্যুবরণ করেন। আগেই উল্লেখ করেছি, যুদ্ধ নয়,শান্তি চাই লেখা প্লাকার্ড নিয়ে সারাজীবন এখানেই কাটিয়ে দিয়েছেন। তাকে নিয়ে দুনিয়ার সব বড় বড় নিউজ মিডিয়া হৈচৈ করেছে। কত মানুষ তাকে দেখার জন্য বিশ্বের নানাপ্রান্ত থেকে ছুঁটে এসেছেন।  সবাই বিস্মিত ও অবাক হয়েছেন, হোয়াইট হাউজের সামনে বসে প্রতিবাদ জানানো তার জন্য ছিল  কতটা  চাপের, প্রতিকূলতার। অনেকবার নিষেধাজ্ঞা, হুমকির মুখোমুখি হয়েছেন। তবুও মাথা নত করেননি । একবার  নব্বই দিনের কারাদণ্ড ভোগ করেছেন। তা সত্ত্বেও প্রতিবাদের ঝান্ডা উর্ধ্বে তুলে  টিকে ছিলেন দৃঢ় মনোবল নিয়ে। ২০১৪ সালে আমার আমেরিকা ট্যুরে সবচেয়ে বড় পাওয়া ছিল কনি'র মতন সাহসী মানুষের স্বল্প সময়ের সানিধ্য। সেই দিনটি আমার সারাজীবনের পরম স্মৃতি হয়ে আছে।

কনি ১৯৮১ সাল থেকে ২০১৬ সাল অবধি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান, জর্জ ডাব্লিউ বুশ, জুনিয়র বুশ, বিল ক্লিনটন, বারাক ওবামার সবচে নিকটতম প্রতিবেশি হিসেবে ৩২ বছর প্রতিবাদের ঝান্ডা নিয়ে বেঁচে ছিলেন। কনির জন্ম ১৯৪৫ সালে স্পেনের ভিগোতে। শৈশবে তিনি এতিম হন। একুশ বছর বয়সে এক ইতালিয়ান ব্যবসায়ীর প্রেমে পড়ে বিয়ে করেন। এক কন্যা জন্মের পর ১৯৭৩ সালে ‘একটি নোংরা বিবাহবিচ্ছেদ’এর মাধ্যমে সন্তান হারান, এক বুক দুঃখ-বেদনা নিয়ে দেশত্যাগ করে নিউ ইয়র্ক আসেন। পরে ওয়াশিংটন এসে হোয়াইট হাউজের সামনে  তিনি  আসন গাড়েন।জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বিশ্ব শান্তির পক্ষে একাই লড়ে গেছেন।

 

২৫.০২.২০২১

 

মন্ট্রিয়েল

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন