ঐতিহ্য বাঁচাতে এলিজার লড়াই

শাহিদুল ইসলাম ভ্রমণের রয়েছে এন্তার উপাদান। কেউ প্রকৃতি দেখতে পছন্দ করেন। কেউ নদী। কেউবা শুধুই খাদ্য ভ্রমণে আনন্দ পান। কিন্তু এর বাইরে এমন কিছু উপাদান আছে যা অনেক ভ্রমণ পিপাসু মানুষ বেছে নেন নিছক সখে নয় সেসব স্থপনার ঐতিহাসিক গুরুত্ব মানুষের কাছে তুলে ধরতে। এমন একটি বিষয় বললে ভুল হবে না যে আমাদের ঐতিহ্যের অংশ অর্থাৎ শিকড় অন্বেষণ যারা নেশা- তিনি এলিজা বিনতে এলাহি।  তিনি একা পথেই হাঁটছেন। ঘুরছেন দেশে দেশে। তার এই পথচলা শুরু ১৯৯৯ সাল থেকে। বর্তমানে ২০২০। নানান আর্থিক কষ্ট সয়েও শিক্ষকতার ফাঁকে ফাঁকে অর্থ জমিয়ে নতুন নতুন দেশকে জানতে ছুটে যাচ্ছেন। আর এই ছুটে যাওয়া দেশের তালিকায় যুক্ত করেছেন ৪৯টি দেশের নাম। তবে তার এই ভ্রমণ খাওয়া-দাওয়া, শপিং কিংবা সিনেমা দেখার জন্য নয়। প্রতিটি দেশেই তিনি ছুটছেন ঐতিহ্যের অন্বেষণে, নেপথ্যের ইতিহাসের সন্ধানে। আর QUEST..a heritage journey of Bangladesh। আর নিজ দেশের ৬৪ জেলার ঐতিহ্য বাঁচাতে করছেন তথ্য সংগ্রহ। তা ডিজিটাল মাধ্যমে ধারণ করে ছড়িয়ে দিচ্ছেন দুনিয়াজুড়ে। তার টার্গেট একটাই। ঐতিহ্যের মাধ্যমে দেশকে বিশ্বের বুকে তুলে ধরা। সংসার, শিক্ষকতা আর ভ্রমণ এই তিনে মিলে লড়ছেন হেরিটেজ সংরক্ষণে সচেতনতা গড়তে। স্বামী ব্যবসায়ী ফাইয়াজ আলম খান আর একমাত্র সন্তান নবীনেওয়াজ খানের সহযোগিতায় এলিজা এগিয়ে যাচ্ছেন।

নিজ দেশের ৬৪ জেলার ঐতিহ্য বাঁচাতে করছেন তথ্য সংগ্রহ

এলিজা বলেন, ছোট থেকেই ইতিহাসপ্রেমী ছিলাম, প্রত্নতত্ত্ব কাছে টানতো। প্রত্নতত্ত্ব স্থাপনাগুলো তৈরির পেছনের মানুষগুলোর ভাবনা তার কারিগররা আমাকে শুধু মানুষের সীমাহীন ক্ষমতার কথা মনে করিয়ে দিত। এই ইট পাথরের ভবনের ভেতরের সৃজনী শক্তি থেকে আমি এক ধরনের শক্তি অনুভব করতাম। আর তাই এই সীমাহীন শক্তি অনুভব করতেই ছুটে যাই ইট পাথরের স্থাপনার কাছে। তিনি যুক্ত করেন, মানুষের অসাধ্য কিছুই নেই, শুধু স্বপ্ন দেখতে হবে। এই সব ঐতিহ্যের পেছনে যখন প্রথমদিকে ছুটেছি তখন মানুষ হাসতো। বলতো, ভাঙা বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে এত খুশি হওয়ার কি আছে। কিন্তু এখন যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই এলাকার ইতিহাস সংগ্রাহকদের খুঁজে বের করে কথা বলি। তখন সকলে অবাক হয়। এটাই আমার আনন্দ। আমার নেশা হচ্ছে, ভ্রমণ আর ইতিহাসের বই সংগ্রহ। যেভাবে শুরু একেবারে তিন বছর বয়স থেকেই ভ্রমণ শুরু। ঢাকা থেকে ট্রেনে যখন জামালপুর যেতাম তখন থেকেই তা চোখে ভাসে। আর অনানুষ্ঠানিক বিশ্ব ভ্রমণ শুরু ১৯৯৯ সালে। জীবন উপভোগের একটি মাধ্যম মনে হয় আমার কাছে ভ্রমণ। রহস্যময় এই পৃথিবীর স্বাদ এই স্বল্প সময়ের জীবনে দেখার বাসনা থেকেই ভ্রমণ শুরু। তবে দেশের বাইরে যাওয়ার আগেই নিজের দেশ দেখেছি উদ্দেশ্যহীনভাবে। আমি কোনো গবেষক বা এক্সপার্ট নই। ভ্রমণ আমার নেশা, ভালোবাসা। আর এই ভ্রমণের উপাত্ত ইতিহাস দুটোই আমার ভালোবাসার বিষয়। সেই জায়গা থেকেই আমার উচ্চতর পড়াশোনায় যুক্ত করেছি বাংলাদেশ ট্যুরিজম। বাংলাদেশ ট্যুরিজম নিয়ে কাজ করি ২০০৮ সালে।

ভ্রমণকে জীবন উপভোগের একটি মাধ্যম হিসেবে দেখেন এলিজা

প্রথম গবেষণাপত্র তৈরি করি,  Publiciing Tourism:  opportunity and challenges in the context of Bangladesh. আর দ্বিতীয়টি ২০১৮ সালে নেদারল্যান্ডসে ‘ A communication plan for Bangladesh Govt. to promote Bangladesh as a Global Tourist Destination ’ দুটি গবেষণা পত্রেই আমি উলে­খ করেছি কি কি পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে বাংলাদেশকে একটি বিশ্ব পর্যটনের দেশ বানানোর জন্য। ২০১৬ সালে শুরু করলাম আমার ব্যক্তিগত প্রজেক্ট, QUEST..a heritage journey of Bangladesh, এটি মূলত দেশজুড়ে হেরিটেজ ট্যুরিজম বিকাশের জন্য। ঢাকার বলধা গার্ডেন দিয়ে শুরু করেছিলাম। সময়টি ছিল ২০১৬ সালের ১৭ই মে, শেষ করেছি চলতি বছরের ২৮শে আগস্ট চট্টগ্রাম জেলার মাধ্যমে। আমার পড়াশুনার বিষয় কখনো ইতিহাস বা প্রত্নতত্ত্ব ছিল না। নিজের ইচ্ছার তাগিদে আমি আমার প্রফেসরদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আমার শখের বিষয়কে পড়াশুনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছি। আমার কাজের সঙ্গে সবসময় বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করেছি। শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে আমি এখন পর্যন্ত ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম ও জাপানে ৮টি ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে যোগ দিয়েছি। সেখানে বাংলাদেশের ট্যুরিজম এবং বেগম রোকেয়ার অবদানের কথা তুলে ধরেছি। হেরিটেজকে বেছে নিলেন কেন? বাংলাদেশে প্রত্নতত্ত্ব, ইতিহাস কিংবা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য কোনো কিছুর কমতি নেই। শুধু ঘাটতি হচ্ছে সেই ঐতিহ্যকে যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থা। আমরা সমৃদ্ধ ছিলাম, আছি, নয়তো যুগে যুগে বিশ্ব পর্যটকরা কেনই আমাদের দেশে আসবেন বা রচনা করবেন ভ্রমণগাঁথা।

আমাদের প্রাচীন ইতিহাস আমরা জানতে পারি তাদের লেখনি থেকেই। অনেক আগেই বঙ্কিম চন্দ্র বলেছেন, ইতিহাস রক্ষায় বা লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে রয়েছে আমাদের উদাসীনতা। সে কথাই হয়তো সত্য। আর সেই পরিস্থিতি মাথায় রেখেই হেরিটেজের পেছনে ছুটছি। ইতিহাস রক্ষায় বা লিপিবদ্ধ করার কথা মাথায় রেখেই হেরিটেজের পেছনে ছুটছি[/caption] ভ্রমণের নেশায় পেলো কি করে? একটি নতুন শহরে ভ্রমণ (দেশে অথবা বিদেশে) মানেই নতুন কিছু শেখা, নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয়, নতুন কিছু জানা। বাংলাদেশে ৬৪ জেলা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, যা কিছু দেখেছি, জেনেছি, মানুষের সঙ্গে মিশেছি সব কিছু যদি লিপিবদ্ধ করতে চাই, তাহলে এক জীবনে সম্ভব হবে না। ভ্রমণ আমার কাছে স্রেফ ঘুরে বেড়ানো নয়, বরং ভ্রমণ মানে ইতিহাস, প্রেরণা ঐতিহ্য, শক্তি, সংস্কৃতি, শিক্ষা, আত্মপরিচয়, আর শেকড়ের সন্ধানে এক বিনির্মাণের যাত্রা। ২০ বছরের বিশ্ব ভ্রমণের যাত্রায় আমার নিজেকে সত্যিকার ট্রাভেলার মনে হয়েছে যখন আমি বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় কোনায় কোনায় গিয়েছি। আমার দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, মানুষ আমাকে যা আনন্দ দিয়েছে পৃথিবীর বড় বড় দেশ তা দিতে পারেনি। আমি দেখেছি গর্ব করার মতো বিশ্বমানের স্থাপনা আমাদেরও রয়েছে। প্রয়োজন শুধু সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রচার প্রচারণা। কতদূর যেতে চান? বিশ্ব ভ্রমণের কথা যদি বলেন দেখতে চাই পুরো বিশ্ব। মৃত্যু অবধি ভ্রমণ করতে চাই। আর বাংলাদেশকে তুলে ধরতে চাই, হেরিটেজ ট্যুরিজমের এক অনন্য স্থান হিসেবে বিশ্ব পর্যটকদের কাছে। বর্তমানে কাজ করছি বছরে একদিন যেন হেরিটেজ ট্যুরিজম ডে হিসেবে পালন করা হয় তা নিয়ে। কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছি। অপেক্ষা, কি দাঁড়ায়।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন