একদিন সারাদিন ল্যুভর মিউজিয়ামে (পর্ব-৪)

মাসুুদুল হাসান রনি

২০১৩ সালে প্রথম ল্যুভর মিউজিয়াম দেখে ফেসবুকে কিছু ছবির সাথে স্ট্যাটাস লিখে দেই, 'সারাবেলা ল্যুভরে।' সাথে সাথে রঙ বাংলাদেশের সত্বাধিকারী চিত্রসশিল্পী সৌমিক দাস কমেন্ট করেন,' রনি ভাই, একবেলায় ল্যুভর ঘুরে কিছুই দেখা সম্ভব না। ' আসলেই তাই। এত বিশাল ল্যুভর মিউজিয়াম তা ঘুরে দেখতে ২ দিন লেগে যাবে। আমি সেদিন সিদ্ধান্ত নেই, আবার প্যারিস এলে ল্যুভর মিউজিয়াম দুইদিন না হোক একদিন সারাদিন এখানেই কাটাবো। এর পরের তিনবছর ১/২ বার করে প্যারিস যাওয়া হলেও আর ল্যুভর যাওয়া হয়নি। সময় কিংবা সুযোগ মেলেনি। সেই কাঙ্খিত সুযোগটি হঠাৎ পেয়ে যাই ২০১৭ সালের জুন বা জুলাই মাসে পোল্যান্ডের পোজনান থেকে আবার প্যারিস আসার পর। এ যাত্রায় জার্মান,পোল্যান্ড ও প্যারিসে প্রায় চার মাস ছিলাম। বরাবরের মতন প্যারিসে আমার ছোটবোন চিকিৎসক ফারহানার  লা পমিয়ে'র বাসায় উঠি।

এবার প্যারিসে ছিলাম প্রায় মাসখানেক। প্রতিদিন বিকেলে টুকটুক করে প্যারিসের অলিগলি ঘুরে বেড়িয়েছি। কখনো একা, কখনো শওকত ভাই, কখনো সোহা কিংবা আমার দল বাসদের কমরেডদের সাথে। একদিন পড়ন্ত বিকেলে সোহার সাথে মাঁরিশিতে কফিশপে আড্ডা দিচ্ছি। সুরাইয়া সোহা আলজেরিয়ান বংশোদ্ভুত ফ্রান্সের নাগরিক, আমার পোল্যান্ডের ক্লাসমেট। হঠাৎ সোহা বললো, অনেক কিছু দেখলে কাল চলো ল্যুভরটা ঘুরে দেখি। এতো দেখি মেঘ না চাইতে জল। আমি সুযোগটা হাতছাড়া করতে রাজী নই। সাথে সাথে বলি, অবশ্যই দেখব। কালই যাবো আমরা। কফিপান করতে করতে দুইজনে মিলে ঠিক করি ল্যুভরের স্থাপত্য, ভাস্কর্য আর বাছা বাছা কয়েকটা পেন্টিং দেখব।

ল্যুভর মিউজিয়ামের সামনে লেখক

পরের দিন খুব সকালে আমি ল্যুভর মিউজিয়ামে চলে আসি। সকাল ন'টায় সোহা ও তাঁর বড়বোন সানা চলে আসে। প্যারিসের আবহাওয়া ভাল থাকায় সকাল থেকেই প্রচুর ভীড়। আমরা তিনজনেই লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ১৬ ইউরো করে তিনটি টিকেট ৪৮ ইউরোতে কেটে সিকিউরিটি পেরিয়ে পিরামিডের ভেতরে ঢুকে পড়ি। মজার ব্যাপার হচ্ছে , ২৫ বছরের নিচের ইউরোপিয়ান নাগরিকদের জন্য মিউজিয়ামে টিকেট লাগে না এবং বেকারদেরও লাগে না।

প্রবেশ পথটা আধুনিক শপিংমলের মত। যদিও মিউজিয়ামটা পুরনো রাজপ্রাসাদের ভেতরে। প্রায় ১৫ একর জমির ওপর। ঢুকতে চোখে পড়ে বিশাল চত্বরের মাঝে পিরামিড। পুরনো আর নতুনের ফিউশন বলা হয় রাজপ্রাসাদের সামনে কাঁচের তৈরি পিরামিডটাকে।মিউজিয়ামের মুলভবনে প্রবেশের আগে জেনে নেই ল্যুভরের ইতিহাস। আমরা যারা ছবিতে যে ল্যুভর মিউজিয়াম ভবন দেখি তারা অনেকেই জানেন না, এই ভবনটি রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ বারো শতকে দুর্গ হিসেবে তৈরি করেছিলেন । ক্রুসেডের যুদ্ধে যাওয়ার আগে প্যারিস শহরকে ভাইকিং দস্যুদের হাত থেকে রক্ষার জন্য তিনি এ দুর্গ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেইন নদী আর শহরের সংযোগস্থলে নির্মিত হয় ল্যুভর দুর্গ।

প্যারিসের আবহাওয়া ভাল থাকায় সেদিন সকাল থেকেই প্রচুর ভীড়

পরবর্তী সময় রাজা প্রথম ফ্রান্সিস বর্তমান ভবনটি তৈরি করেন। ১৬৪২ সালে চতুর্দশ লুইস ভার্সিলিসে চলে যাবার আগে ল্যুভর দুর্গকে রাজ সংগ্রহশালায় পরিনত করেন। তখন ল্যুভরে ঠাঁই হয় বিভিন্ন আর্ট একাডেমির। এই একাডেমিগুলো নিয়মিত তাদের সদস্যদের শিল্পকর্মের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতো। আঠারো শতকে ল্যুভরকে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার শুরু হয় । ফরাসি বিপ্লবের সময় চতুর্দশ লুইস ও তার স্ত্রীকে টুইলারিস প্রাসাদে কারারুদ্ধ করা হয় এবং ১৭৯৩ সালে সেখানেই তাদের শিরোচ্ছেদ করা হয়। টুইলারিস প্রাসাদটি ছিলো ল্যুভর সংলগ্ন। সে বছরই আগস্টে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির নির্দেশে ল্যুভরকে জাদুঘর হিসেবে সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ৫৩৭টি চিত্রকর্ম নিয়ে ল্যুভর আনুষ্ঠানিক ভাবে গণ-জাদুঘর হিসেবে এর যাত্রা শুরু করে।

ল্যুভরকে মিউজিয়াম হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের অবদান অনেক বেশী। তার শাসনামলে ল্যুভরের সংগ্রহ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়।বিভিন্ন দেশ আক্রমন করে নেপোলিয়ন ও তার সৈন্যরা লুট করা সব শিল্পকর্ম আসতো এখানে। সেই সময়ে তিনি ল্যুভরকে নিজের নামে নামকরণও করেন। তবে ১৮১৫ সালে নেপোলিয়ানের পরাজয়ের পর অনেক বস্তুই তার প্রকৃত মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। ল্যুভরে মিশরীয় পুরাকীর্তি বিভাগসহ অন্যান্য বিভাগ সমৃদ্ধ হয়েছে নেপোলিয়নের অভিযানগুলোর ফলে। ল্যুভর জাদুঘর বিশ্বের পুরনো জাদুঘরগুলোর অন্যতম।এটি শুধু জাদুঘর নয়, এখানে আছে আর্ট গ্যালারিও। ল্যুভর কেন বিখ্যাত প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, ল্যুভরে রয়েছে মধ্যযুগ থেকে শুরু করে ১৮৪৮ অর্থাৎ উনিশ শতক পর্যন্ত পশ্চিমা শিল্পের এক বিশাল সমাহার। পৃথিবীর অন্যকোন জাদুঘরে এতো সংগ্রহ রয়েছে কিনা সন্দেহ। এখানে আছে প্রাচীন সভ্যতার অসংখ্য নিদর্শনও। বর্তমানে ল্যুভরের সংগ্রহে ৩৮০,০০০ বেশি দর্শনীয় বস্তু রয়েছে।

ল্যুভরের মোট আয়তন ছয় লাখ বায়ান্ন হাজার স্কয়ার ফুট। চারটি ফ্লোর এবং তিনটি উইং। ডেনন, সুলি ও রিচিলিও। বিভিন্ন উইংয়ে দেশ বা মহাদেশভিত্তিক চিত্রকলা ভাস্কর্য দিয়ে সাঁজানো হয়েছে। পিরামিড পেরিয়ে ল্যুভরের মুল লবিতে আমরা তিনজন পাশাপাশি হাঁটছি। ল্যুভরে আমার দ্বিতীয়বার আসা। সোহা ও সানা অনেকবার এসেছে। কিন্তু প্রতিবারই ল্যুভর নতুনই লাগে। গ্যালারিগুলোতে আবিস্কার করি কত অজানা ইতিহাস। দেখি বিশ্বখ্যাত শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, দনাতেলো, মিকেলেঞ্জেলো, হেনরি মাতিসসহ অনেক বিখ্যাত শিল্পীর শিল্পকর্ম। অবাক বিস্ময়ে দেখি প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা।গ্যালারি ঘুরে দেখি ভাস্কর্য আর সেই যুগের পাথরের তৈরি বিভিন্ন নিদর্শন ।

 

মিউজিয়ামের একটি গ্যালারিতে দেখা পাই নেপোলিয়ন বোনাপার্টের। তাঁর বিশাল পোর্ট্রেটের পাশে রাখা মুকুট ও তলোয়ার। আহা! কে না জানে এই তলোয়ারের সাথে জড়িয়ে আছে কত রক্ত! কত মানুষের শেষ মুহুর্তের আর্তনাদ! ল্যুভর মানে মোনালিসা। সারাবিশ্ব থেকে প্রতিদিন দর্শনার্থীরা ল্যুভরে আসেন মোনালিসার ভুবন ভোলানো হাসি দেখতে। আমাদের তিনজনের আসলে ধৈর্য ছিল না অন্যকিছু দেখার। শুরু থেকে উদগ্রীব ছিলাম কখন ভিঞ্চির গ্যালারির সামনে যাব। কখন মোনালিসার সাথে দেখা হবে!

সারাবিশ্ব থেকে প্রতিদিন দর্শনার্থীরা ল্যুভরে আসেন মোনালিসার ভুবন ভোলানো হাসি দেখতে

ইতালিয়ান, গ্রিক, ঈজিপশিয়ান গ্যালারিগুলোতে ঘুরতে ঘুরতে খুব অল্প সময়ের মধ্যে চলে আসি কাঙ্খিত শিল্পকর্মের সামনে। ডেনন উইংয়ের দোতলায় প্রথমবার যখন মোনালিসাকে দেখি তখন বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। আজও তাই হলো। কিছুসময় দুর হতে হা করে তাকিয়ে দেখেছি। বিশ্বাস হচ্ছিল না, সত্যি কি আমি মোনালিসার সামনে দাঁড়িয়ে আছি? আমার অবাক বিস্ময় দেখে সোহা কৃত্রিম অভিমানী কন্ঠে জিগেস করে, ও কি আমার চেয়ে সুন্দর? আমার তখন মাথায় কিছুই কাজ করছিল না। কিছু বলার আগে আমার হয়ে সানা উত্তর দেয়, মোনালিসার প্রেমে পড়েনি পৃথিবীতে এমন মানুষ বিরল। রনি'র বিস্মিত না হওয়াটা কি অস্বাভাবিক নয়?

এমনিতেই মোনালিসার খুব কাছাকাছি যাওয়া যায় না। প্রচুর দর্শনার্থী ঠেলে কোনভাবেই আমরা মোনালিসার সামনে যেতে পারি না। এতো লোক দেখে মনে হচ্ছিল ল্যুভর দেখতে নয়, মোনালিসাকে দেখতে সবাই ছুঁটে এসেছেন।মোনালিসার চারদিক থেকে বুলেট প্রুফ কাঁচে ঘেরা। এটি পাহারা দেয়ার জন্য দেহরক্ষীর মতো সবসময় প্রহরী থাকে। তারপরও ১৯১১ সালে এটি চুরি হয়েছিল এবং দু’বছর পর পুনরুদ্ধার করা হয়। আমরা কাছে যেতে না পেরে মন খারাপ করে অন্যদিকে চলে আসি। দুঃখ রয়ে গেল মোনালিসার সাথে ছবি তুলতে না পারার।

আমরা ভিঞ্চির অন্যান্য ছবি দেখি। এ গ্যালারিতে বেশ কিছু তৈলচিত্র আছে। এর মধ্যে ভাল লেগেছে মেরী ও তার মায়ের সাথে শিশু যীশুকে নিয়ে আঁকা ‘দ্য ভার্জিন অ্যান্ড চাইল্ড উইদ সেইন্ট অ্যানি’। চমৎকার একটি ছবি। এ গ্যালারি ওই গ্যালারি জুড়ে শুধু চিত্রকর্ম নয়, প্রতিটি ফ্লোরে রয়েছে ভাস্কর্য। মধ্যযুগ থেকে শুরু করে হাল জামানার শিল্পীদের কত সহস্র শিল্পকর্মে ঠাসা ল্যুভর! সব কিছু দুইদিন কেন সাতদিনে দেখেও শেষ করা যাবে না। বিভিন্ন গ্যালারিতে অ্যাবস্ট্রাক্ট , রিয়েলিজম , সুরেলিজম, কিউবিজম , মডার্ন কিংবা ইউরোপীয় রেঁনেসা'র সময়কার ছবিগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যতোটা সম্ভব দেখি। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ছবির পার্থক্য কি তার একটা ধারনা নেয়ার চেস্টা করি।

হেনরি মাতিস আমার প্রিয় শিল্পী। তার আঁকা ছবিগুলো অনেকটা সময় নিয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখি। এছাড়া সৌন্দর্য এবং প্রেমের দেবী ‘ভেনাস দ্য মিলো’ আমাকে মুগ্ধ করেছে। মার্বেল পাথরের নিঁখুত এই মূর্তিটা তৈরি হয়েছিল প্রায় ১০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে, গ্রীসে। নারীর সৌন্দর্যের আর শিল্পকর্মের এক অনন্য নিদর্শন । ভাল লেগেছে শিল্পী জ্যাক-লুই ডেভিডের আঁকা প্যারিসের নটরডাম চার্চে রাজা প্রথম নেপোলিয়নের রাজ্যাভিষেকের অয়েল পেন্টিংটি।

ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্তি এসে ভর করছিল। তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে দেখতে থাকি স্থাপত্য ও ভাস্কর্য । কোনটা ব্রোঞ্জের , কোনটা মার্বেল পাথরের, কোনটা গ্রানাইটের, কারও ওপরে আবার সোনার কারুকাজ। মানুষের আকৃতিসম মূর্তিগুলো এতই জীবন্ত— তাদের মুখের অভিব্যক্তি, শরীরের প্রত্যেকটা পেশীর রূপায়ন— তাকিয়ে দেখার মত। কতটা নিবেদিত প্রাণ হলে এত নিঁখুত করে শিল্প গড়া যায়!

নেপোলিয়নের মুর্তি

বেলা গড়িয়ে দুপুর তিনটে বেঁজে গেছে। দেখার নেশা মেটে না। কিন্তু ক্ষুধায় সবার পেটে আগুন জ্বলছে। সহ্য করতে না পেরে রণেভঙ্গ দেয় সোহা। চলো কিছু খাই। এটা আরো দুইদিন দেখেও শেষ করা যাবে না। আমি মনে মনে বলি, সৌমিক তুমি ঠিকই বলেছো। দুইদিন কেন সাতদিনেও ল্যুভর দেখে শেষ করা যাবে না। বের হবার আগে চোখে পড়ে এককোনে ইসলামিক কর্ণার। এ কর্ণারে সপ্তম শতক থেকে শুরু করে উনিশ শতকের ইসলামী স্থাপত্যশিল্প, ধাতব কাজ, সিরামিক, টেক্সটাইল, কার্পেট, পাণ্ডুলিপি ও আরও অনেক শৈল্পিক সৃষ্টির সংগ্রহে সমৃদ্ধ। তাড়া থাকায় একনজর দেখে সামনে পা বাড়াই।

যেতে যেতে দেখি মমি রাখার কফিন, নানা রকম গয়না, ভাস্কর্য, আরও কত কিছু। খুব বেশি পরিচিত কিছু ছাড়া কোনটা যে কি তা নিজেও জানিনা। সব শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। এত বড় যাদুঘরের সব কিছুর পরিচিতি ফ্রেঞ্চ ভাষায় লেখা। প্রতিটা জিনিষের সামনে ফ্রেঞ্চের পাশাপাশি ইংরেজীতে একটা ছোট বর্ণনা লেখা থাকলে দর্শনার্থীদের বুঝতে, জানতে সুবিধা হতো। ইংরেজী বলা বা লেখায় ফরাসীদের প্রচন্ড অনীহা আছে। আছে নাক উঁচু ভাব। এ থেকে ল্যুভরও মুক্ত হতে পারেনি।

এবারও ল্যুভর পুরোপুরি দেখা হলো না। আগামীতে আবারও প্যারিস আসা হলেও ল্যুভর দেখা হবে কিনা জানি না। দুইদফায় যতটুকু দেখেছি তাই বা কম কি?

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন